২৫ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১২:১৬

আদালতের পর্যবেক্ষণ মানি এবং মানি না

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : ছাত্র সমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশে আর কোনো কোটা পদ্ধতি থাকবে না। আমরা করতালি দিয়েছিলাম। যাই হোক, এবার দেশে মেধার মূল্যায়ন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এই বলে যুক্তিও দেখিয়েছিলেন যে, সংস্কারের প্রয়োজন নেই। কারণ সংস্কার করলে আবার সেটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন হবে। তাহলে প্রতিবন্ধী ও সমাজের সুবিধা-বঞ্চিতদের বেলায় কী হবে? এরও একটা সুরাহার পথ বের করে তিনি বলেছিলেন যে, তাদের অন্যভাবে পুষিয়ে দেওয়া হবে। তখন শিক্ষার্থীরা দাবি তুললো যে, শুধু কথায় হবে না, এ বিষয়ে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক। এ সরকার কয়েক দিন থুম ধরে থাকলো। তারপর বললো যে, এ ব্যাপারে একটি কমিটি গঠন করা হবে। আমাদের দেশে সাধারণত কোনো কমিটি গঠন করার মানে হলো সে বিষয়ের ইতি ঘটানো। এসব কমিটি বা কমিটির রিপোর্ট সাধারণত আলোর মুখ দেখে না। ছাত্র সমাজের মধ্যে সংশয় আরও বেড়ে গেল। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ঝুলে গেল কোটা সংস্কার। এই সংশয় খুবই স্বাভাবিক ছিল। কারণ তার কয়েক দিনের মধেই নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক ঘোষণা করলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ পার্সেন্ট কোটা বহাল থাকবে। কৃষিমন্ত্রী সংসদে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাকবে নাকি রাজাকারের বাচ্চাদের জন্য কোটা থাকতে হবে। এসব ছাত্রদের মনে নতুন করে সংশয় ও ক্ষেভের সৃষ্টি করল।

এর মধ্যে আকম মোজাম্মেল হক আরেক অদ্ভূত জিনিস আবিষ্কার করলেন। তিনি বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিশ পার্সেন্ট কোটা বিষয়ে আদালতের আদেশ রয়েছে। অতএব আমরা সে আদেশ লংঘন করতে পারি না। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও তার কথা ঘুরিয়ে বললেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে আদালতের আদেশ রয়েছে। আমরা তো আর আদালতের আদেশ লংঘন করতে পারি না। কিন্তু লেজ উল্টিয়ে দেখা গেল- আদালত এ ধরণের আদেশ কখনোই দেননি। আদালতে সাধারণত দু’ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়, একটি আদেশ, অপরটি পর্যবেক্ষণ। আদেশ মান্য করা বাধ্যতামূলক আর পর্যবেক্ষণের বাস্তবায়ন কোনো পক্ষের জন্যই বাধ্যতামূলক নয়। অথচ সেটি জোরেসোরে প্রচার হতে থাকল। বলা হতে থাকল, ঐ পর্যবেক্ষণও যেন আদেশ। সে আদেশ পরিবর্তন করা যাবে না। তা অলংঘনীয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বললেন, আদালত তো পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ত্রিশ পার্সেন্ট কোটা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরাও ত্রিশ পার্সেন্ট কোটার সুবিধা পাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতির কথা তো আদালত বলেনি। তাই আইন বিশেষজ্ঞরা বলছে, আদালতের পর্যবেক্ষণ মানতে সরকার বাধ্য নয়। ২০১৫ সালে আপিল বিভাগের এক রায়ে বলা হয়েছিল, হাইকোর্ট ডিভিশনের পর্যবেক্ষণ হলো এই যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ত্রিশ শতাংশ কোটা অনুসরণ করতে হবে। আদেশ ও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে যে ভিন্নতা রয়েছে, সেটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের বিচারকরাই বলেছেন যে, আদালতের পর্যবেক্ষণ বিচারকদের মতামত মাত্র। সেটি কোনো আদেশ নয়। সুতরাং তা মানা বাধ্যতামূলক নয়। এমনকি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অন্যান্য আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, দীর্ঘকাল ধরে আমাদের বিচার বিভাগের আদেশ ও পর্যবেক্ষণের আলাদা অর্থ স্বীকৃত হয়ে আসছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী সেটি মানতে নারাজ। তিনি আইন বিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ একটি আদেশ এবং সরকার তা পালন করতে বাধ্য। তিনি গত ১৮ই জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলে বসলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিপুতিদের জন্য ত্রিশ শতাংশ কোটায় কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই লাইনে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। যদি তাতে পরিবর্তন আনা হয়, তবে তা হবে সুপ্রীম কোর্টের আদেশের লংঘন। ইতিমধ্যে সরকার কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা, সংস্কার বা বাতিল করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আকম মোজাম্মেল হক সে কমিটির কাছে আদালতের ঐ পর্যবেক্ষণের চিঠিটি পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং তিনি আশা করছেন যে, কমিটি মুক্তিযোদ্ধা কোটা অবিকল রাখবে। প্রধানমন্ত্রীও যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন। এবং তিনিও জাতীয় সংসদে বললেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতিপুতিদের কোটা বহাল থাকবে। আদালতে যেখানে কোটা সংরক্ষণের আদেশ দিয়েছে তাহলে আমরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে যাই কিভাবে?
বর্তমানে সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশই কোটার জালে আটকা পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতিপুতিদের জন্য আছে ত্রিশ শতাংশ, দশ শতাংশ নারীদের জন্য, দশ শতাংশ অনুন্নত জেলার জন্য, পাঁচ শতাংশ উপজাতীয়দের জন্য এবং এক শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য। আন্দোলনকারী ছাত্ররা বলেছিল, এই কোটা পদ্ধতি অযৌক্তিক এবং তা সংস্কার করা হোক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর যুক্তিটা আজব। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আদালতের পর্যবেক্ষণ মান্য করা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক কিনা? জবাবে তিনি বলেছিলেন, প্রথমে হাইকোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, সুপ্রীম কোর্টও তা সমুন্নত রেখেছেন। সুতরাং এটা আদালতের আদেশ হয়ে গেছে। আমরা তা মান্য করতে বাধ্য। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট নিজেও হাইকোর্টের মন্তব্যকে পর্যবেক্ষণ বলেছেন, আদেশ বলেননি। এ সম্পর্কে আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাও মোজাম্মেল হকের বক্তব্যকে সমর্থন করে না। তিনি বলেছেন, হাইকোর্ট কোনো পর্যবেক্ষণ দিলেও এবং সুপ্রীম কোর্ট তা বহাল রাখলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা আদালতের আদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়- ততক্ষণ পর্যন্ত তা আদেশ নয়। সুতরাং আদালতের পর্যবেক্ষণ পালন না করা আদালত অবমাননা নয়। তবে তিনি বলেছেন, আদালতের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিৎ। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ বাস্তবিক অর্থে বিচারকের মতামত, আদেশ নয়। সুতরাং সে মতামত না মানলে তা আদালত অবমাননা হবে না। প্রখ্যাত আইনজীবী ড.শাহদীন মালিকও একইভাবে মত দিয়েছেন। তারও মতে আদালতের পর্যবেক্ষণ মান্য করা বাধ্যতামূলক নয়।
আবার সরকার সর্বক্ষেত্রেই আদালতের এই পর্যবেক্ষণ যে মান্য করে চলে, এমনও নয়। বহুক্ষেত্রে সরকার আদালতের আদেশও মান্য করে না। একই রকম পর্যবেক্ষণ আদালত দিয়েছিল- মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স সম্পর্কে। সেখানে কোটার কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। কিন্তু সেই রায়েই বিচারপতিগণ এই মতপোষণ করেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের কোটা ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। অথচ মামলাটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স সংক্রান্ত। তাতে বোঝা যায় যে, এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততিদের চাকরির বিষয়টি ছিল নিতান্তই বাত কে বাত। সেটি বাস্তবায়নের কোনো আদেশ আদালত দেননি। আর তাই এটা সরকারের উপরই নির্ভর করে যে, বর্তমান কোটা ব্যবস্থায় তারা পরিবর্তন আনবেন কি আনবেন না। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি আদেশে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, কোটা বিষয়ে তারা কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নন। গত পাঁচই মার্চ কোটা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। কিন্তু হাইকোর্ট এই বলে তা বাতিল করে দিয়েছেন যে, বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী যে দাবি করেছেন তা অত্যন্ত সুবিধাবাদি নীতি। আর তাই কোটা সংস্কারের বিরোধিতা করার জন্য আদালতের পর্যবেক্ষণের উপর জোর দিয়ে আসছেন। অথচ ঐ মামলায় আদালত যে রায় দিয়েছিলেন, গত ৬ বছরেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্ট সরকারকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, অবসরপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার যেন অবসরকালীন ভাতা এক বছর বাড়িয়ে দেন এবং তা যেন ২০১০ সাল থেকে কার্যকর হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ করেছিল। ২০১৩ সালে তা আবারও বাড়িয়ে ৬০ বছর করা হয়।
আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৩ সালে সরকারের কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলাও গত ৫ বছর ধরে হাইকোর্টে পড়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও এ নিয়ে সরব হয়ে ওঠে। তারা বলতে থাকেন যে পর্যবেক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা বরাদ্দ ছিল, কিন্তু ২০১১ সালে সরকার নতুন বিধান করে তাদের নাতিপুতিদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়। যা আদালতের আদেশ ও পর্যবেক্ষণের বাইরে ছিল। এছাড়া দেখা গেছে, অতীতে সরকার আদালতের বহু পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করেছে। কিন্তু এর জন্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার কোনো মামলা হয়নি। কারণ তা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানবিরোধী ঘোষণা করা হয় ২০১১ সালে। সেখানে সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, তবে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তাতে আরও বলা হয়েছিল, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার ৪২ দিন আগে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। সরকার এর কোনো পর্যবেক্ষণই মানেনি। যদিও আদালতের আদেশে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ বাতিল করতে কসুর করেনি।

http://www.dailysangram.com/post/339207