২৪ জুলাই ২০১৮, মঙ্গলবার, ৫:০১

কয়লা কেলেঙ্কারিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ, তদন্তের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

দুর্ভোগে ৮ জেলার দেড় কোটি মানুষ

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা গায়েব হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে উত্তরাঞ্চলের আট জেলায় বিদ্যুৎ সংকটে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দেড় কোটি মানুষকে। সামনের অন্তত এক মাস ওই আট জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে। এই সময়ে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। খনির কয়লা গায়েবের ঘটনা নজরে আসার পর গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে।

বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রংপুর বিভাগের আট জেলায় গতকাল থেকে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আগের চেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে সোমবার থেকে। টানা দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লোডশেডিং হয় কোথাও কোথাও। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের এ প্রভাব জাতীয় গ্রিডেও পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধা থেকে উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, সোমবার থেকে অস্বাভাবিকহারে লোডশেডিং হচ্ছে। আগে যেখানে দিনে দু’একবার লোডশেডিং হতো সোমবার দিনে ১০ থেকে ১২ বার লোডশেডিং হয়েছে। এছাড়া কয়েক মিনিট পর পর লোডশেডিং হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন গ্রাহকরা। একই অবস্থা আশেপাশের জেলাগুলোতেও।

খনি থেকে উত্তোলনকৃত ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী কয়লা সরবরাহে ব্যর্থ হয় খনি কর্তৃপক্ষ। কয়লা গায়েবের ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন মহাব্যবস্থাপককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আরো একজন মহাব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে কয়লা খনি কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ। ঘটনাটি তদন্তে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বড়পুকুরিয়া খনির ইয়ার্ডে ১ লাখ ৪৬ হাজার টন কয়লা থাকার কথা। এই হিসাবই পিডিবিকে মৌখিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল। কিন্তু মজুতাগারে গতকাল দুই হাজার টনের মতো কয়লা পেয়েছে দুদকের একটি দল। বাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা কোথায় গেল- এর কোনো জবাব মিলছে না।

বড়পুকুরিয়া খনি সংশ্লিষ্টরা জানান, এই খনি থেকে খোলা বাজারে কয়লা বিক্রি করা হয়। এই বিক্রিতে একটি মহল বেশি পরিমাণ কয়লা বিক্রি করে খাতায় কম হিসাব দেখাতে পারে। আবার কয়লা না তুলেও চীনা কোম্পানি অতিরিক্ত উত্তোলন দেখিয়ে বেশি অর্থ নিয়ে যেতে পারে।

গত সপ্তাহে খনির শিফট পরিবর্তনের সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লা সংকটে পড়ায় বিষয়টি সবার নজরে আসে। পিডিবি’র সদস্য সাঈদ আহমেদ কয়লা খনি পরিদর্শনে গিয়ে মাত্র ১০ হাজার টন কয়লা মজুত পান। ওই সময় তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যেই কয়লার অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। ওই সময় কয়লা গায়েবের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।’

তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল হাকিম জানিয়েছেন, ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট চালু রাখতে দৈনিক ৫ হাজার ২০০ টন কয়লা প্রয়োজন। কিন্তু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রে দিনে ৬শ’ থেকে ৭শ’ টন কয়লা সরবরাহ করেছে। এতে প্রথম, দ্বিতীয় ইউনিটটি বন্ধ করা হয়। কয়লার অভাবে রোববার রাত ১২টার পর থেকে তৃতীয় ইউনিটটিও বন্ধ করতে বাধ্য হয় পিডিডি কর্তৃপক্ষ।

প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ, তদন্তের নির্দেশ: কয়লা গায়েবের ঘটনা নজরে আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল সচিবালয়ে অফিস করে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জনপ্রশাসন পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর হঠাৎ করে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের জানান সচিবালয়ের দপ্তরে অফিস করবেন। সচিবালয়ের দপ্তরে বসে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠান।

তাদের কাছে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা চুরি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকাসহ উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। পরে নিজ দপ্তরে ফিরে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানান, কয়লা সংকটের কারণে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় আগামী একমাস রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। এ জন্য এলাকাবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, কয়লা চুরির বিষয়ে ইতিপূর্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, সবার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

তিনি বলেন, আপাতত সিরাজগঞ্জে উৎপাদিত কিছু বিদ্যুৎ রংপুর অঞ্চলে সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সিরাজগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বন্ধ থাকা বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুই ইউনিটের একটিতে ৮৫ মেগাওয়াট অন্যটিতে ২৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদন হতো। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুইটি ইউনিটে ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন এই বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় প্রতিদিন ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন।

এর মধ্যে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসতো বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কয়লা সংকটের কারণে এক মাস ধরে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২টি ইউনিট বন্ধ থাকায়, সেখান থেকে মাত্র ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসতো। এ কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় এ ঘাটতি আরো বাড়লো। এদিকে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হলেও বাইরে থেকে বিদ্যুৎ এনে চাহিদা পূরণ করা হবে। তবে এতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে লোডশেডিংও হতে পারে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একটি ক্ষেত্র থেকে নতুন ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরের জন্য ১৬ই জুন থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পুনরায় কয়লা উত্তোলন শুরু হবে আগস্টের শেষের দিকে।

এ সময়ের মধ্যে পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার মজুত রয়েছে বলে ২০শে জুন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) নিশ্চিত করে খনি কর্তৃপক্ষ। মজুতকৃত এ কয়লা দিয়ে আগস্ট পর্যন্ত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখা যাবে বলে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু জুলাইয়ের শুরু থেকেই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে হঠাৎ কয়লার সরবরাহ কমিয়ে দেয় খনি কর্তৃপক্ষ। ৪-৫ দিন আগে কর্তৃপক্ষ পিডিবিকে জানিয়ে দেয়, খনির কোল ইয়ার্ডে কয়লার মজুত শেষ পর্যায়ে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেশিদিন কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এরপরই কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়।

অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি: দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করা কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনার অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এজন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে। দুদকের উপ-পরিচালক শামসুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক এএসএম সাজ্জাদ হোসেন ও উপ-সহকারী পরিচালক এ এন এম তাজুল ইসলাম। আর সার্বিক অনুসন্ধানের তদারকি করবেন দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল ইসলাম। দুদক সূত্র বলছে, আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ওই ঘটনার অনুসন্ধান শেষ করে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে হবে।

প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে: খনি থেকে কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা।

সোমবার বিকালে খনিতে প্রবেশ করে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং কোল ইয়ার্ড এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তারা। দুদক কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, খনির অনিয়মের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে তদন্ত কার্যক্রম শেষে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গতকাল দুপুরে দুদকের পাঁচ সদস্যের দল খনি এলাকা পরিদর্শনে আসেন। দুদকের কর্মকর্তারা কয়লা খনিতে প্রবেশ করে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও কোল ইয়ার্ড এলাকা পরিদর্শন করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসেন।

এ সময় সাংবাদিকদের তারা বলেন, ‘কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, ‘আমরা কয়লা খনির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, খনির কোল ইয়ার্ডে ১ লাখ ৪৬ হাজার টন কয়লা মজুত থাকার কথা। কিন্তু কোল ইয়ার্ডে রয়েছে মাত্র ২ হাজার টন কয়লা। বাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস নেই। বিপুল পরিমাণ কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ায় এখানে প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির আলামত পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যেই আমরা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় দুদক অফিসে জানিয়েছি। খনির কয়লা গায়েবের ঘটনায় ইতিমধ্যে দুইজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত, এমডিকে অপসারণ এবং এক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=127252&cat=2