২৪ জুলাই ২০১৮, মঙ্গলবার, ৪:৫৮

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা-সনদ বাণিজ্য ঠেকাতে কঠোর হচ্ছে আইন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ২৫ শতাংশ সদস্য শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে রাখতে হবে। ২৫ হাজার বর্গফুটের পরিবর্তে ৩৫ হাজার বর্গফুটের ক্যাম্পাস থাকতে হবে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের। সিন্ডিকেট-একাডেমিক কমিটির মতো অর্থ কমিটিরও প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

যৌন হয়রানি রোধে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একটি করে কমিটি গঠন করতে হবে। শিক্ষার্থীর সনদে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষ নয়; ভিসি, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর থাকবে। পাস করা শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে ওয়েবসাইটে। শিক্ষা ও সনদ বাণিজ্য ঠেকাতে এ ধরনের নানা বিধান যুক্ত করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ৩ বছর আগে এ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি বহু আগে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু এ নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের একটি বড় অংশ বিরোধিতায় নামে। যে কারণে সংশোধনী ধামাচাপা পড়ে।

সর্বশেষ গত ২৭ মে সংসদীয় কমিটির ২৭তম বৈঠকে সংশোধনীর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (মালিক) সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুনানি করা হয়। তাতে সমিতির চার সদস্যই সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধারার ওপর আনা সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তবে কমিটির সদস্যরা শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবিত সংশোধনীর পক্ষে অনড় আছেন বলে জানা গেছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও আইন সংশোধন উপ-কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, স্থায়ী কমিটি আইনের একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। বিভিন্ন ধারার অন্তত ১৫টি সংশোধনী তালিকাভুক্ত করে এর ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির নেতাদের সঙ্গে শুনানি করা হয়েছে। হয়তো কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা আসতে পারে। যদিও মালিক পক্ষ মনে করছে, বিদ্যমান আইনে কোনো সংশোধনীই প্রয়োজন নেই। সে রকমই তারা মতামত দিয়েছেন।

জানা গেছে, সংসদীয় কমিটির ২৭তম বৈঠকে সংশোধনীর প্রস্তাব আনা দিকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে আইনের ৬ ধারা সংশোধন করে ট্রাস্টি বোর্ডে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ রাখা ও বোর্ডে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা তাতে আপত্তি জানান। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. আফছারুল আমিন এক-চতুর্থাংশ হলেও শিক্ষাবিদ রাখার জন্য ২৫তম বৈঠকের প্রস্তাবের পুনরুক্তি করেন।

সংশোধনী প্রস্তাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডে সরকারের পর্যবেক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সিন্ডিকেটে আরও একজন সরকারি প্রতিনিধি নিয়োগের প্রস্তাব আছে। কিন্তু সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন পর্যবেক্ষক নিয়োগ বা শিক্ষাবিদ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার জন্য সিন্ডিকেট আছে। এর বেশিরভাগ সদস্য সরকার মনোনীত প্রতিনিধি।

অপরদিকে ট্রাস্টি হওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। বিদ্যমান ট্রাস্টিরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অর্থায়ন করেন। তাই এ ধরনের প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত নয়। সভাপতি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২৫ হাজার বর্গফুটের শর্ত সংশোধন করে ৫০ হাজার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি ৩৫ হাজার করা যেতে পারে এবং এ শর্ত ভবিষ্যতে স্থাপিতব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলে চলমান শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।

শেখ কবির হোসেন সিন্ডিকেটে ইউজিসি মনোনীত দু’জন শিক্ষাবিদ সদস্য যুক্ত করা সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, ভিসি, প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষই সরকারের প্রতিনিধি। তাই আরও দুই সদস্য প্রয়োজন নেই। তিনি প্রতি দুই মাসে একটি করে সিন্ডিকেট সভা ডাকার বিধান যুক্ত করার বিরোধিতা করে বলেন, এতে সময় ও অর্থের অপচয় হবে।

আইনের ২৪ নম্বর ধারায় পাঠ্যক্রম অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবিত কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সদস্য মনোনয়নের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন সমিতির নেতারা। কিন্তু পেশাজীবী সদস্য মনোনয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন।

আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করে শিক্ষক নিয়োগ ও অর্থ কমিটির প্রধান করা হয়েছে ভিসিকে। এতে নিয়মিত সমাবর্তন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। ৩১(৮) নম্বর ধারা সংশোধন করে ভিসিকে সিন্ডিকেটের কাছে দায়বদ্ধ থাকার প্রস্তাব করা হয়। বিদ্যমান ধারায় ট্রাস্টি বোর্ড বা মালিকদের কাছে দায়বদ্ধ হিসেবে আছে। কিন্তু বৈঠকে মালিকপক্ষ প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর বিরোধিতা করেন।

আইনের খসড়া সংশোধনীতে ৩৫ নম্বর ধারায় ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দ্বন্দ্ব’ সৃষ্টি হলে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনের ৩৭ নম্বর ধারায় ‘কমিশন কর্তৃক প্রণয়নকৃত গাইডলাইন’, ৪৩ নম্বরে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত গাইডলাইন তৈরি, ৪৪ নম্বরে সাধারণ তহবিল পরিচালনা সম্পর্কে নানা নির্দেশনা এবং ৪৮ ও ৪৯ নম্বর ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও শাস্তির ব্যাপারেও সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।

এসব প্রস্তাবের মধ্যে মালিক সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন স্থায়ী আমানতের ওপর অর্জিত সুদের অর্থ উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের জন্য ইউজিসির পূর্বানুমোদনের প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি প্রোগ্রাম অনুমোদন নিতে গেলে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। সেখানে তহবিল ব্যয়ের অনুমোদন যুক্ত করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উন্নয়ন কাজই হবে না। তাই কমিশনকে শুধু ‘অবহিত করা’র বিধান যুক্ত করা যেতে পারে আইনে।

তিনি ৪১ ও ৪২ নম্বর ধারা সংশোধনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নির্ধারণের দায়িত্ব ট্রাস্টিবোর্ডের কাছেই রাখতে হবে। ইউজিসির কাছে দেয়া হলে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেবে। বৈঠকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে এর সম্পদ বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ ব্যবস্থা সুগম করার তাগিদ দেন। তিনি আইন সংশোধনের চেয়ে ইউজিসি পুনর্বিন্যাস জরুরি বলে বৈঠকে উল্লেখ করেন।

বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল বেনজীর আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘লাভজনক’ ও ‘অলাভজনক’ উভয় ধরনের স্বীকৃতি আইনে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ট্রাস্টি বলেন, যেখানে স্বাস্থ্য খাতে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লাভজনকভাবে পরিচালিত হতে কোনো বাধা থাকতে পারে না।

তিনি আইনের বিভিন্ন ধারা ধরে ধরে সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। বেনজীর আহমেদ বলেন, যৌন হয়রানি রোধে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে সেল আছে। তাই নতুন করে এটি করার প্রয়োজন নেই। সংশোধনীতে ইউজিসি ১২-১৪ জন করে শিক্ষাবিদ প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে ১০৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০৬০ জন শিক্ষাবিদ লাগবে। এত শিক্ষাবিদ কোথায় পাওয়া যাবে। তিনিও আইনের ২৫ নম্বর ধারায় অর্থ কমিটি গঠনের সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

জানা গেছে, বৈঠকে সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়কে লাভজনক হিসেবে গণনা সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে একে অবাধে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলেও বেতন-ভাতা, টিউশন নির্ধারণে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বক্তৃতায় আরও বলেন, অর্থ কমিটির সভাপতি হিসেবে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকে দেয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। তবে শিক্ষক নিয়োগে ইউজিসি প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব তিনি সমর্থন করেন। বৈঠকে সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীও বিভিন্ন ধারা সংশোধনের বিরোধিতা করেন। ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকীও বিভিন্ন ধারার সংশোধনী প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করেন। একটি পর্যায়ে তিনি বলেন, ভিসিকে অর্থ কমিটির সভাপতি করার প্রস্তাব হাস্যকর।

তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি বিধিমালা নেই, তাদের জন্য আইনের ৪৩ ধারায় সংশোধনী আনা যেতে পারে। কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রণে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুন্দরভাবে চলছে। তাই এগুলোকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার প্রয়োজন নেই। তিনি মনে করেন, ফি নির্ধারণের ভার সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের কাছেই ন্যস্ত থাকতে পারে। তবে কত টাকা পর্যন্ত টিউশন ফি নেয়া যাবে- তার সর্বোচ্চ হারটা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে।

ইউজিসির একজন সদস্য বৈঠকে মালিক সমিতির বিভিন্ন সমালোচনার জবাব দেন। পাশাপাশি আইনের উল্লিখিত ধারাগুলোয় সংশোধনী আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

২০১৫ সালের অক্টোবরে আইন সংশোধনের প্রস্তাব তৈরির জন্য সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুসকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দিনকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন : ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান ও ইউজিসির একজন সদস্য।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/73292