২৩ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ৫:১৩

মহাসড়কে বৈধ চালকহীন ৮২ হাজার ভারী যান

দেশে বাস ও ট্রাকের মতো ভারী যানবাহনে প্রায় ৮২ হাজার লাইসেন্সধারী চালকের অভাব রয়েছে। প্রতিটি ভারী যানে একজন করে চালক থাকার হিসাব থেকেই এ ঘাটতি দেখা যায়। এ ছাড়া মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ানো ৮০ শতাংশ ট্রাকই জরাজীর্ণ। মহাসড়কে রাতে চলাচলরত বেশির ভাগ বাসেরও নেই ফিটনেস বা উপযুক্ততার সনদ। এ অবস্থার মধ্যেই দূরপাল্লার বাসে বিকল্প চালক রাখার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ‘দক্ষ চালক’ তৈরির প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়তে সরকারের কাছে জায়গা বরাদ্দ চেয়েছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। আর সরকার দক্ষ চালক তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকারি কয়েকটি কেন্দ্রে। সেগুলো হলো যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দূরপাল্লার বাসে বিকল্প চালক রাখার ওই নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী বাস ও ট্রাকচালকদের জন্য প্রাথমিকভাবে দেশের চারটি মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব বিশ্রামাগার থাকবে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়কে। এ জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে সমন্বয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, এসব বিশ্রামাগারে গাড়ি রাখার পর্যাপ্ত জায়গা, চালকদের বিশ্রামের জন্য ১০টি করে বিছানা, তাদের বিনোদনের জন্য টেলিভিশন, খাবারের ব্যবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা রাখা হবে। এসব বিশ্রামাগার পরিচালনা করা হবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিশেষ নির্দেশনা দেন। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং নৌপরিবহনমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মধ্যে ছিল কোনো চালকের একটানা পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি না চালানো এবং বিকল্প চালক রাখা। তিনি মহাসড়কে বাস ও ট্রাকচালকদের জন্য নির্ধারিত সময়ের পর বিশ্রামের অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টিরও নির্দেশ দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে একাধিক বৈঠক করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। গত ৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিশাখা থেকে সর্বশেষ সভার কার্যবিবরণী পাঠানো হয়েছে অংশীজনদের কাছে। গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত সভার ওই কার্যবিবরণী থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয় জানার পর সওজ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে তৎপরতা বাড়িয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় ওই সভায়। কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমানকে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, নিবন্ধিত গাড়ির তুলনায় বৈধ চালক কম। এখন বড় দায়িত্ব দক্ষ চালক তৈরি করা।

বিআরটিএর তথ্য মতে, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত হয়েছে ২০ ধরনের ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬২০টি যানবাহন। এসব যানবাহনের বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালক আছে ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জন।

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, দেশে সরকারিভাবে নিবন্ধিত যানবাহনে একজন করে চালক রাখা হলেও প্রায় অর্ধেকসংখ্যক যানবাহনেই বৈধ লাইসেন্সধারী চালক নেই। দেশে বাস ও ট্রাকসহ ভারী যানবাহন আছে দুই লাখ ২০ হাজার ৭৬৫টি। এসব নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে চালকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার ৭৪৫টি। দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে নিবন্ধিত ভারী যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স প্রায় ৮২ হাজার কম।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারী গাড়ির তুলনায় চালক না থাকার কারণ বিআরটিএর হয়রানি ও বিভিন্ন শর্ত। ভারী গাড়ি তাই চালকের সহকারীরাও চালায়।

বৈধ কিংবা অবৈধ চালকদের বড় একটি অংশ নিষেধ না মেনে মহাসড়কে মাত্রাতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। যাত্রীদের অনুনয় উপেক্ষা করে মোবাইল ফোনে অনবরত কথা বলতে বলতেও চালকরা ভারী গাড়ি চালান গতিসীমা না মেনে। গত ২৩ জুন ভোরে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। সংশ্লিষ্ট বাসচালক আমিনুল হোসেনের কাছে বৈধ লাইসেন্স ছিল না। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আলম এন্টারপ্রাইজের বাসটিরও ফিটনেস সনদ ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। দুর্ঘটনার পরদিন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্পত্তি শাখা) শিশির কুমার রায়কে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করেছিল মন্ত্রণালয়। শিশির কুমার রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বাসটি চালাচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘আমরাও তদন্ত প্রতিবেদনে দূরপাল্লার যাত্রায় বিকল্প চালক রাখা, চালককে পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে বাধ্য না করা, চালক নিয়োগ দেওয়ার আগে তার গাড়ি চালানোর বৈধ লাইসেন্স আছে কি না তা গাড়িমালিকদের বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করে দেখার নিয়ম চালু করার সুপারিশ করেছি। গাড়ি চালানো শুরুর আগে চালকের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা গাড়িমালিককে পরীক্ষা করে দেখা, রাস্তায় সংশ্লিষ্ট গাড়িটি চলাচলের উপযুক্ত কি না ও সেটির উপযুক্ততার সরকারি সনদ আছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুপারিশ করেছি।’

২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে ৩৭টি প্রাণ ঝরেছিল তিন অদক্ষ বাস চালকের দোষে। দুর্ঘটনার পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কেয়া পরিবহনের বাসের ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট ছিল না। নাটোর-গুরুদাসপুর পথে চলাচলকারী অথৈ পরিবহনের বাসের নিবন্ধনই ছিল না। অথৈ পরিবহনের গাড়ির চালক আলম মণ্ডলের ছিল না ড্রাইভিং লাইসেন্স।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় জেল-জরিমানা বাড়িয়ে, নতুন লাইসেন্স পেতে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাসের বাধ্যবাধকতার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া তৈরি করেছিল। সেটি অনুমোদন করা হয়েছিল গত বছরের ২৭ মার্চ। নতুন আইন পাস হলে, চালকের সহকারী হতে গেলে লাইসেন্স নিতে হবেই। এ জন্য অন্তত পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হতে হবে। বর্তমানে মোটরযান অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত নেই। নতুন আইন পাস হলে কেউ গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। সড়ক পরিবহন নেতাদের আন্দোলনসহ নানা চাপে এটি ঝুলে আছে।

এক লাখ নতুন গাড়িচালক তৈরি করবে সরকার : দেশে এক লাখ নতুন দক্ষ গাড়িচালক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে ৩৬ হাজার নতুন গাড়িচালক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। এ জন্য বিআরটিসির জনবল বাড়ানো হবে। এরই মধ্যে গাজীপুরে বিআরটিসি ডিপো পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে চালক তৈরির ট্রেড চালুর জন্য সুপারিশ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে সড়ক নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা সচেষ্ট আছি।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/07/23/661143