১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৩২

পুরান ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ৪শ’ রাসায়নিক গুদাম: এখনও বন্ধ হয়নি মৃত্যুকূপ; বেশির ভাগই অনুমোদনহীন, মার্চ থেকে উচ্ছেদ অভিযান, ডিএসসিসিসহ ৫ সংস্থা মাঠে নামবে

 

পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ৪শ’ রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদ অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ ৫টি সংস্থা একযোগে মাঠে নামবে। আগামী ১ মার্চ থেকে এ অভিযান শুরুর কথা আছে। তবে এর আগে পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে।


চকবাজার, লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকার আবাসিক ভবনের নিচতলার পার্কিং স্পেসে গড়ে উঠেছে এসব গুদাম। কিছু বাড়িতে কারখানাও আছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর নিমতলী থেকে কিছু গুদাম ও কারখানা সরানো হয়েছে। তবে পুরান ঢাকার অন্য এলাকা থেকে খুব বেশি সরেনি। বারবার উদ্যোগ নেয়ার পরও রহস্যজনক কারণে অপসারণ হয়নি অনুমোদনবিহীন এসব কেমিক্যাল গুদাম। বন্ধ হয়নি মৃত্যুকূপ। ফলে পুরান ঢাকার কয়েক লাখ মানুষ ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়েই পার করছেন দিনরাত্রি। তবে এবার ডিএসসিসির এ কর্মসূচির সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, র্যাব, পুলিশ, বিস্ফোরক অধিদফতর এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, নিরাপদ নগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কেমিক্যাল গুদাম ও কিছু কারখানা বিপজ্জনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। নিমতলীর ঘটনার পর সরকার কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে ফেলার নিদের্শনা দিলেও ব্যবসায়ীরা তা মানেননি। এবার সরাতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, মালিক যেই হোক না কেন তার গুদাম অপসারণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধি হলেও তাদের ছাড় দেয়া হবে না।

নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পরিবার-পরিজন হারানো আসমা আক্তার শান্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় আমার পরিবারের চারজনকে হারিয়েছি। আর নানা-মামাদের পরিবারের ৪০ জনকে হারিয়েছি। এ হারানোর বেদনা কাউকে বোঝানো যাবে না।’ স্বজন হারানোর পর আসমা আক্তার শান্তা, সাকিনা আক্তার রতœা ও উম্মে ফারওয়া আক্তার রুনাকে প্রধানমন্ত্রী কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেন। অবিলম্বে পুরান ঢাকার বাসাবাড়ি থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে ফেলার জন্য কন্যারা তাদের মা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন। তারা বলেন, সরানো না হলে যে কোনো সময় এসব গুদাম থেকে নিমতলীর মতো দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। প্রসঙ্গত ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর একটি বাড়ির নিচতলায় থাকা রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নারী-শিশুসহ ১২৪ জন মারা যান। দগ্ধ হন দুই শতাধিক মানুষ। এরপর সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা ওই এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

গত কয়েক দিন সরেজমিন দেখা গেছে, পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজার, লালবাগসহ আশপাশের এলাকার বহুতলবিশিষ্ট ভবনের গাড়ি পার্কিং স্পেস বা নিচতলায় কেমিক্যালের গুদাম গড়ে উঠেছে। এসব ভবনের অন্যান্য ফ্লোর বাসাবাড়ি এবং ছোট-বড় কোম্পানির অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একাধিক ভবনে নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউন এবং উপরের একাধিক ফ্লোরে প্লাস্টিকের কারখানা লক্ষ্য করা গেছে। এলাকাবাসী জানান, কেমিক্যালের গন্ধে বাতাস দূষিত হয়ে গেছে। ফলে তারা নানা ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব কারখানা ও গুদাম অপসারণের দাবি জানান।

জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সদস্যরা পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ চারশ’ প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রস্তুত করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব কেমিক্যাল গুদাম ও কারখানার অধিকাংশরই বৈধ কাগজপত্র এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। এ কারণে ন্যূনতম নিয়ম-কানুনও তারা মানছেন না। অদৃশ্য কারণে এসব গুদাম অপসারণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিকার। ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদামের মধ্যে রয়েছে বংশাল থানা এলাকায় প্রায় ৩শ’ গুদাম। আর লালবাগ ও চকবাজার থানা এলাকায় রয়েছে আরও একশ’ গুদাম।

এসব গুদামের মধ্যে আছে- গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল, টলুইসহ ভয়ংকর রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। এসব রাসায়নিক সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকাসহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় এমন অসংখ্য অনুমোদনহীন কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে। প্রাথমিকভাবে পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ গুদামগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ১৯ জানুয়ারি থেকে ২৪ সদস্যের ‘হেজমত’ টিম ৪টি ইউনিটে ভাগ হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অনুসন্ধান করে এ তালিকা তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত করা হয়েছে এ তালিকা।

লালবাগ এলাকার কাউন্সিলর ওমর-বিন-আবদাল আজিজ যুগান্তরকে বলেন, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর কেমিক্যাল গুদাম বন্ধের ব্যাপারে সরকার তৎপর ছিল। এ কারণে নতুন করে কোনো কেমিক্যাল কারখানা গড়ে ওঠেনি। তবে আগেরগুলো রয়েছে বহাল তবিয়তে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার আরমানিটোলার এসি রায় রোডের মেসার্স কেমিক্যাল সেন্টার। দোতলা ভবনের নিচতলায় অবস্থিত এ গুদাম। এর পূর্ব দিকে রাস্তা, পশ্চিমে পুরাতন মার্কেট, উত্তরে দোকানঘর এবং দক্ষিণে দোকানঘর। ২০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের গোডাউনটিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম সোডিয়াম কার্বনেট ও ব্লিচিং পাউডার। ওই গোডাউনে কাজ করেন ৩ জন শ্রমিক।

২৫ বছর ধরে এখানে কেমিক্যাল গুদামজাত করলেও কোনো ট্রেড লাইসেন্স বা কেমিক্যাল কারখানার সনদ নেই। নেই ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনও। তারপরও দিব্যি চলছে ব্যবসা।

এ প্রসঙ্গে রাসায়নিক গুদামের মালিক শ্রী উৎপল রায় যুগান্তরকে বলেন, তার পূর্বপুুরুষ থেকে সবাই রাসায়নিকের ব্যবসা করে আসছেন। এ ব্যবসা বন্ধ করে দিলে তার পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবে। তবে লাইসেন্স বা কেমিক্যাল কারখানার সনদ না নেয়ার বিষয়ে প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি ওই অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার মালিক।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা শাহজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, নিমতলী ট্র্যাজেডির পর কয়েকবার কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। কিন্তু উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি আরও বলেন, এসব কেমিক্যাল গুদাম শুধু ঝুঁকিপূর্ণ নয়, আবাসিক ভবনের নিচে দাহ্য পদার্থ রাখা ও কেনাবেচার কারণে এলাকাবাসী নানা ধরনের শারীরিক রোগ-ব্যাধিতে ভুগছেন। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বেশিরভাগ মানুষই শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। তিনি আরও বলেন, ভবনের মালিকরা বেশি টাকার লোভে জীবনের ঝুঁকি বিবেচনা না করেই কেমিক্যাল গুদামের জন্য ভাড়া দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিডি-অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন যুগান্তরকে বলেন, কেমিক্যাল গুদামের ৯৮ ভাগই অনুমোদনহীন। আর যে দুই ভাগের অনুমোদন রয়েছে, তাও নদীর ওপারে। কিন্তু তারা শর্ত ভঙ্গ করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গুদামগুলো তৈরি করেছে। আর এসব কেমিক্যাল গুদাম থেকে যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস চাইলেও এগুলো উচ্ছেদ করতে পারে না। গুদাম উচ্ছেদ করতে হলে পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন ও বিস্ফোরক অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহায়তা প্রয়োজন।

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে পুরান ঢাকায় নতুন করে কোনো কেমিক্যাল গুদামের লাইন্সেস দেয়া হচ্ছে না। পুরনো লাইন্সেসও নবায়ন করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী কেরানীগঞ্জের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় গুদাম তৈরি করেছেন। বাকি যেসব ব্যবসায়ী এখনও পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় আছেন, তাদের সরিয়ে নিতে স্থানীয় প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/17/101719/%E0%A6%8F%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7-%E0%A6%B9%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%82%E0%A6%AA