১৯ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:২৩

ভল্টের সোনা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

সব সোনা ঠিক আছে, ঘরেই আছে -অর্থ প্রতিমন্ত্রী * জমা নেয়া স্বর্ণ পরবর্তী পরীক্ষায় ভিন্ন ক্যারেট ও মান পাওয়া গেছে -শুল্ক গোয়েন্দা ডিজি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের সোনা ঠিক আছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, জমা দেয়ার সময় সোনার যে মান (ক্যারেট) ছিল, পরবর্তী পরীক্ষার সময় তা পাওয়া যায়নি।
বুধবার অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে সচিবালয়ে টানা দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে অর্থ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, ভল্টে রাখা সোনা ঠিক আছে এবং ঘরেই আছে। ভল্টে রাখা স্বর্ণ নিয়ে অনিয়মের খবর যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতিতেই এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে এ ঘটনার তদন্তকারী সংস্থা শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে সোনা পরীক্ষা করে আমরা যা পেয়েছি, তদন্ত রিপোর্টে তা সঠিকভাবে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছি।
পত্রপত্রিকায় দেখেছি ৮০ শতাংশ ৪০ শতাংশ হয়ে গেছে। সেটি তাদের পাট। তবে প্রতিবেদনে সোনার ক্যারেটের পরিমাণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমরা সঠিকভাবে উল্লেখ করেই তা পাঠিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ক্যারেটের সোনা জমা নিয়েছে পরে পরীক্ষার সময় তা পাওয়া যায়নি। সে সময় ভিন্ন ক্যারেটের সোনা পাওয়া গেছে। মেশিনে ও সনাতন পদ্ধতি উভয়ভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দু’ভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। সবাই এক মত হয়ে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লিখিত পেলে পুনরায় তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনা নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনিয়মের তথ্য পায়। তবে অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে বুধবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের স্বর্ণ নিয়ে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, এনবিআরের সদস্য কালিপদ হালদার, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম, কাস্টমস কার্যক্রম মূল্যায়ন ও অডিট কমিশনার ড. মইনুল খানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সোনা বদলে যাওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা আইনানুগভাবে খতিয়ে দেখা হবে। অর্থমন্ত্রী দেশে ফিরলেই এ পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, এতে সব ধরনের সন্দেহ ও সংশয় দূর হবে। ঘটনাটিকে মোটেও ছোট করে দেখা হচ্ছে না, কারণ সামান্য ফাঁক দিয়েও বড় সমস্যা হয়ে যেতে পারে। পর্যালোচনা করে কারও বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন।

ঘটনা তদন্তে কোনো কমিটি হবে কিনা- এ প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পর্যালোচনা করব। আলোচনার ভিত্তিতে আমরা একমত হয়েছি, তারাও (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) একমত হয়েছেন যে, এটা দেখার বিষয় আছে। আমি মন্ত্রীকে ব্রিফ করব, তদন্ত কমিটি হবে নাকি পর্যালোচনা কমিটি হবে- ল্যাংগুয়েজটা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে এটা আইনানুগভাবে দেখা হবে। যাই করব, আইনের মাধ্যমে করা হবে। তদন্ত শব্দটি আমি ব্যবহার করছি না।

অর্থ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, পত্রিকায় ওই খবর দেখে প্রথমে তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। এ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। যেভাবে খবরের কাগজে এসেছে এটা ভয়াবহ ব্যাপার মনে হয়েছে। যতটুকু সম্ভব বিভিন্ন জায়গায় কথাবার্তা বলে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করেছি। বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ব্যাখ্যা দেয়ার পর সেই উদ্বেগ প্রশমিত হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে আশ্বস্ত হয়েছে- যে মাত্রায় খবর পরিবেশিত হয়েছে তা সঠিক নয়। অনেক বড় মাত্রায় এটি এসেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন মাঝেমধ্যে ধারণাগত ফারাক হতে পারে। এটি নতুন কিছু নয়। ভল্টের সোনা ঠিক আছে দাবি করে তিনি বলেন, এ সম্পর্কে পরিষ্কার হয়ে গেছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা উভয়ে বসছি, আরও বসব। তিনি বলেন, ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনায় যে গরমিলের কথা বলা হয়েছে তা মোটেই ঠিক নয়। সব সোনা ঠিক আছে, ঘরেই আছে। এ কথা যে সঠিক তা জনগণ বা যে কোনো সংস্থা চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে দেখে আসতে পারে।

তিনি বলেন, ৪০ শতাংশ ও ৮০ শতাংশের সমস্যা হয়েছে, এটি ‘ক্লারিক্যাল এরর’। লেখার মধ্যে ইংরেজি বাংলা মিশ্রণ হয়ে গেছে। কিছু ব্যাপার আমরা করি, মান্ধাতা আমলের সোনা মাপার কষ্টিপাথর দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, এখন সর্বশেষ কিছু সিস্টেম ইলেকট্রনিক যন্ত্রে সোনার ক্যারেট মাপা হয়। এর মধ্যে চুল পরিমাণ কিছু বেশকম হতে পারে। উভয় নির্বাহী কর্তৃপক্ষ আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, ভয়ের কিছু নেই।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভল্ট থেকে কিছু বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা মোটেও নেই। সেখানে ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে, গভর্নরও অনুমতি ছাড়া ভল্টে যেতে পারেন না। এ লেভেলে অন্য কোনো সংস্থাকে দিয়ে ফারদার পর্যালোচনা করব। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক ভীত নয়, তাদের গভর্নর বলে গেছেন, তাদের মনে কোনো সংশয় নেই, ঠিকই আছে সবকিছু।
বাংলাদেশ ব্যাংক যাকে ‘ক্লারিক্যাল ভুল’ বলছে, সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা পর্যালোচনা করব পুরো সিস্টেমের। এর মধ্যে নিরাপত্তা, মাপঝোঁক, ব্যক্তি, যারা কাজ করে সবকিছুই রিভিউ করা হবে। যদি কারও সামান্যতম গাফিলতি পাই, তাহলে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তদন্ত চলার সময় কেন বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পারল না যে, তাদের ভুল হয়েছে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে এক বছর ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছে, মাঝে মাঝে একজনের চিঠি দিয়ে আরেকজনের জবাব পেতে দুই মাস লেগেছে, কিছু আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি আছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/71444