১৮ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ৪:৩৮

ইসির আস্থা পুনরুদ্ধারের বড় পরীক্ষা

স্বদেশ ভাবনা

আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠেয় তিন সিটিতে নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

১২ জুলাই নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক শেষে সিইসি সাংবাদিকদের আরও বলেছেন, ‘তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেই নির্দেশনা দিয়েছি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথাও ইসি শুনেছে। সবার আশা, সুষ্ঠুভাবে এ তিন সিটির নির্বাচন করা সম্ভব হবে’ (যুগান্তর, ১৩ জুলাই)। সবার আশা পূরণে ৩০ জুলাই তিন সিটি কর্পোরেশন রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে ইসির আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালনার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি গঠনের অল্পদিন পরই মার্চে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মধ্য দিয়ে এ কমিশনের শুরুটা ভালোই হয়েছিল।
গত বছর ডিসেম্বরে রংপুর সিটি নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লায় জাতীয় সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রার্থী এবং রংপুরে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি প্রার্থী মেয়র পদে জয়ী হন। এ দুই সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে ইসি দেশবাসীর প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু এর পরই ইসি পথ হারিয়ে ফেলে।

১৫ মে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি নির্বাচনে ইসি কুমিল্লা ও রংপুরের সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। এখানে অনিয়ম ও কারচুপি সংঘটিত হয়। তবে খুলনা সিটি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) জানায়, ‘খুলনায় অনিয়ম ছিল, তবে ফল বদলে দেয়ার মতো নয়।’ খুলনা সিটিতে মেয়র পদে জয়ী হন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
খুলনা সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই ওই নির্বাচনের ত্র“টি ও ঘাটতি পর্যালোচনা করে ইসি ভবিষ্যৎ নির্বাচনে নতুন পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ছিল তাদের খুলনা সিটি ভোটে অনিয়মের কথা স্বীকার করে নেয়ার নামান্তর।
২৬ জুন গাজীপুর সিটিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম ও কারচুপি খুলনা সিটি নির্বাচনের অনিয়ম ও কারচুপিকে ছাড়িয়ে যায়। এসব অনিয়ম ও কারচুপির সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, যদিও ইসি সচিব গাজীপুর সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছেন।
খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের অনিয়ম ও কারচুপি বর্তমান সরকারের আমলে বিগত কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ইসির পরিচালনায় অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অংশগ্রহণহীন নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠনের পরপরই অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ছয় দফায় অনুষ্ঠিত হয় সারা দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় ৯৮ উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ৪৫টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন ৩৪টিতে চেয়ারম্যান পদে। ২৭টি পদে অন্য প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১১৬টি চেয়ারম্যান পদের ৫২টিতে বিএনপি এবং ৪৬টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ১৮টি পদে অন্যরা জয়লাভ করেন।
নির্বাচনে এ ফল দেখে আওয়ামী লীগ চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং ‘যে কোনো উপায়ে’ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা তৃতীয় দফায় ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জাল ভোট প্রদানসহ নানারকম সহিংস কার্যকলাপের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তী দফাগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের এ ধরনের কার্যকলাপের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ইসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন।
এর ফলে তৃতীয় দফা নির্বাচন থেকে ফলাফল উল্টে যেতে থাকে এবং সব ধাপের নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীরা বিএনপি সমর্থিত, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সমর্থিত ও অন্যান্য জয়ী মোট প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি পদে জয়লাভ করেন।

বর্তমান ইসি কুমিল্লা ও রংপুর সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করায় কুমিল্লায় বিএনপি ও রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মেয়র পদে জয়লাভ করলেও কোনো এক ‘জাদুর সোনার কাঠির স্পর্শে’ খুলনা সিটি নির্বাচন থেকে ফলাফলের চাকা ঘুরে যেতে থাকে। খুলনা সিটি নির্বাচন এবং এরপর গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে সরকারি দল মনোনীত মেয়র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।
অনেকে মনে করেন, একই ‘জাদুর সোনার কাঠির স্পর্শে’ রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটিতেও সরকারদলীয় প্রার্থীরা মেয়র পদে জয়ী হবেন। ১৪ জুলাই একটি দৈনিকের হেডলাইন ছিল ‘রাজশাহীতে খুলনার বাতাস!’ বরিশাল ও সিলেটের অবস্থাও তেমন ভিন্ন নয়।
খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি নিয়ে শুধু দেশের মানুষই উদ্বেগ প্রকাশ করেনি, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২৮ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট সে দেশের সরকারের মতামত তুলে ধরে বলেন, খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্যের জবাবে ইসির একজন কমিশনার বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সংজ্ঞা নেই’ এবং তিনি খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অনিয়মের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ দেয়ার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের মতামতের প্রতিফলন না ঘটায় একমাত্র ভারত ছাড়া সারা গণতান্ত্রিক বিশ্ব ওই নির্বাচন নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে এবং তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে তাগিদ দেয়।
অবস্থা বেগতিক দেখে ওই নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই তিনি প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন।

দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রের বিরূপ মন্তব্যে তৎকালীন ইসি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন বলে মনে পড়ে না। এখন বিশ্ব একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে।
গণতন্ত্রের অনুসারী কোনো দেশে গণতন্ত্রের প্রাণ সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিকূল অবস্থায় পতিত হলে কিংবা অগণতান্ত্রিক শক্তি জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে তা নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা মোটেই অস্বাভাবিক নয় এবং এটা সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের পর্যায়ে পড়ে না।
বাংলাদেশের সাড়ে চার দশকে দলীয় সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দলীয় সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকুক। বিশেষ করে দলীয় সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচনে দলীয় সরকার পরাজিত হয়নি।

১৯৭৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে বেসামরিক পোশাক পরিহিত দুই সামরিক শাসকের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময়ে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
স্বাধীনতার প্রথম দু’দশকে জনগণ সহজেই বুঝতে পারেন, সরকারের হস্তক্ষেপে পরিচালিত হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনের ফল আগে থেকেই ছকে বাঁধা থাকায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

জনগণ ইসি এবং নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নির্বাচন, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার গণদাবির ফলে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধন করে প্রবর্তন করা হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এ সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি (সপ্তম, অষ্টম ও নবম) জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ১৯৯৩-৯৫ সালে বিএনপির শাসনামলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়।

আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে জনগণ ইসির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। জনগণের আস্থা ধরে রাখতে আগামী তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই ইসির।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ইসিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরামর্শটি দিয়েছিলেন তা ছিল- নির্বাচন ব্যবস্থায় জনগণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং ইসির ভাবমূর্তি উদ্ধারে নির্ভীকভাবে পথচলা। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমদিকে ইসি এ বিষয়ে কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও তারা সে সাফল্য ধরে রাখতে পারেননি।
আসন্ন তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে আইনগতভাবে না হলেও আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারাবে ইসি। এটা ইসি বা দেশবাসী কারও কাম্য নয়।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/71081