১৬ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১:১১

অনেকের প্রশ্ন- ভোট দিতে পারব তো

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও কোনো কোনো ভোটারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের শঙ্কা- ভোট দিতে পারব তো।

নগরীর বিভিন্ন এলাকার ভোটারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নানা কারণে তাদের মধ্যে এ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রতীক বরাদ্দের পরপরই চলছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আর ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ)’ তৈরি না হওয়ার অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। এছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন এবং বরিশাল অঞ্চলের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে উঠেছে নানা অভিযোগ। এসব বিষয় বিবেচনা করেই মূলত ভোটারদের মনে এমন শঙ্কার সৃষ্টি হয়।

যদিও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- যেসব বিষয় নিয়ে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে- সেগুলোর কোনো কিছুই ঘটবে না বরিশালে। তবে তাদের এই আশ্বাসে মোটেই আশ্বস্ত নয় বিএনপি বা জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা।

আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পর এখানে বিএনপি প্রথম যাকে নিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে তিনি হলেন ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর পিতা সংসদ সদস্য এবং বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছাড়াও যিনি আছেন পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নবিষয়ক পরীবিক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক পদে। শেষোক্ত এই পদটি পূর্ণ মন্ত্রী পদমর্যাদার। নগরীর কালীবাড়ি রোডে পৈতৃক নিবাস থাকা হাসানাত এখানকারই বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বিএনপি বলছে, তিনি নগরীতে অবস্থান করে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করছেন এবং পতাকাবাহী গাড়ি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে দুই দফা লিখিত অভিযোগও দিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বাবা কি এখন বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাবে? দেড়-দু’মাস কি তিনি তার নিজের ঘরে ঘুমোতেও পারবে না? নির্বাচনী আচরণবিধিতে রয়েছে যে এমপি বা মন্ত্রী পদমর্যাদাধারী কেউ নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। আপনারা দেখান যে, তিনি কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন কিনা? যদি দেখাতে পারেন তাহলে রিটার্নিং কর্মকর্তা যে শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেব।’

এর আগে খুলনা এবং গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং হয়রানির অভিযোগ উঠলেও বরিশালে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া এই দলের মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারও বলেননি তেমন কিছুই। রোববার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। নগরীর ১০নং ওয়ার্ডে বিএনপির নির্বাচনী কার্যালয় ভেঙে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধির কথা বলে বাধা দেয়া হচ্ছে বিএনপিকে মিছিলে। অথচ আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে দেদারসে মিছিল হচ্ছে। সেখানে কেউ বাধা দিচ্ছে না।’ প্রশাসন বিএনপির সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঠিক তা নয়, আসলে প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা করছে না। আমরা তাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করছি।’

সরোয়ারের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, ‘উনি একা অভিযোগ করবেন কেন? তেমন কোনো ঘটনা ঘটলে খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনেও তো আসবে। আপনারা তেমন কিছু কি দেখেছেন? কিংবা সংবাদকর্মীরা কি কিছু বলতে পারবেন? আমি তো উল্টো বলতে পারি যে উনার (সরোয়ার) স্ত্রী প্রচার-প্রচারণায় নেমে আমার ভোটারদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।’ প্রশাসনের সহযোগিতা-অসহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন তো আমার কর্মীদেরও ছাড় দিচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে পুলিশি চেকপোস্টে আমার কর্মীদের আটক, এমনকি হয়রানি পর্যন্ত করা হচ্ছে। নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যেই তারা এসব করছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকেও যদি অসহযোগিতা বলা হয়, তাহলে তো আমার কিছু বলার নেই। তাছাড়া এটা তো বিএনপির একটি নিয়মিত আচরণ। নির্বাচনের আগে তারা এভাবে অভিযোগ করতে থাকে। প্রার্থী জিতে গেলে চুপ।’

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দুই প্রার্থীর পাল্টাপাল্টি এসব অভিযোগের পাশাপাশি বরিশাল সিটির অনেক ভোটারের মধ্যে এই মুহূর্তে যে বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে, তা হল ৩০ জুলাই অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারবেন কিনা। আমানতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব ভোটার গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘ভোটে যেই জিতুক তাকেই আমরা মেয়র মানব। কিন্তু ভোটের দিন নিজের ভোটটা শেষ পর্যন্ত নিজে দিতে পারব কিনা সেটাই চিন্তা।’ এখন পর্যন্ত তো বরিশালে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি সেক্ষেত্রে এমন চিন্তা কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের সময় ভোট দিতে গিয়ে দেখেছি যে, আমার ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে। এমপি নির্বাচনেও ভোট দিতে পারিনি। তাছাড়া খুলনা এবং গাজীপুরে ভোটের যেসব খবর শুনেছি সেখানে বরিশালে কি হবে তাই নিয়ে টেনশনে আছি।’ ৩০নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুর ইসলামও প্রায় এই সুরে জানালেন, ‘শুনছি যে এখানে নাকি খুলনা আর গাজীপুরের মতো ভোট কেটে নেয়া হবে। তেমন কিছু হলে ভোট নিয়ে এত মাতামাতি করে কি লাভ?’ বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব বিএনপি ঘরানার সুশীল নেতা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘শঙ্কা তো এখন একটাই, ভোট সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে কিনা।’

সুষ্ঠু ভোট প্রশ্নে বরিশালে সবার আগে শঙ্কার কথা বলেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার। সম্প্রতি সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘বরিশালে যিনি প্রার্থী তার পিতা একজন মন্ত্রী। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের আত্মীয়। যে কোনো মূল্যে তাকে জয়ী করার চেষ্টা হতে পারে। আর সেক্ষেত্রে ভোট ডাকাতি কিংবা ভোট কারচুপি ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর এ কারণেই আমরা আশঙ্কা করছি, এখানে নিরপেক্ষ ভোট হবে না।’ সরোয়ারের এই বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমার পিতা মন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ফুফু এটা কি আমার অপরাধ? দু’দিন পর তো সরোয়ার সাহেবের ছেলেমেয়েরাও রাজনীতিতে আসবেন। তখন তাদের বাবা সাবেক এমপি, হুইপ জেলা মন্ত্রী এবং মেয়র ছিলেন সেটা তাদের জন্য অপরাধ হবে? নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বরিশালে এখন পর্যন্ত একটা অভিযোগও কেউ করতে পারেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে তাদের এসব কথা রাজনৈতিক স্টান্টবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।’

এদিকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নানা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশালে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলালউদ্দিন খান বলেন, ‘মন্ত্রী এবং এমপিদের বাসস্থান যদি নির্বাচনী এলাকার ভেতরে হয়, তাহলে তারা সেখানে অবস্থান করতে পারবেন। কিন্তু কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মোট ১১টি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব অভিযোগের তদন্ত করছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কর্মকর্তারা। সত্যতা পেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/70439