১৬ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১:০৯

ফাঁস অডিও নিয়ে তোলপাড়

ইবির নিয়োগবাণিজ্যে এবার ২০ লাখ টাকা

শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নতুন নয়। দিন দিন বেড়েই চলছে বাণিজ্যে টাকার অঙ্ক। বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে অনেক স্বনামধন্য শিক্ষকেরাও। এ ধরনের অপরাধের যথাযথ বিচার না হওয়াই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির মূল কারণ। অপরাধের সাথে কর্তাব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অনেক সময় সুষ্ঠু বিচারে বিঘœ ঘটে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রবীণ একজন প্রফেসর বলেন, ‘অপরাধ বৃদ্ধির জন্য বিচারে ত্রুটি বা পক্ষপাতমূলক বিচার অনেকাংশে দায়ী। নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপে না গেলে এতে অনেকেই আগ্রহী হবে। ফলে বাণিজ্যের বিষয়টি শিক্ষাঙ্গনে মহামারি আকার ধারণ করবে।’

ফের শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্যসংক্রান্ত অডিও ফাসের ঘটনা ঘটেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত বছর শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিওতে ১৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। তবে এবারের অডিও তে ২০ লাখ দাবি করা হয়েছে। সম্প্রতি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিভাগে নিয়োগপ্রত্যাশী এক প্রার্থীর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষকের অডিও কল রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। টাকা নিয়ে নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হলে এই অডিও ফাঁস করে দেয় প্রার্থী নিজেই।

অডিও ফাঁস হওয়া ওই দুইজন শিক্ষক হলেন, বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাকী বিল্লাহ বিকুল এবং ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. শাহদাৎ হোসেন আজাদ। অডিওতে বিভাগীয় সভাপতি প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর হোসেনেরও সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নিয়োগপ্রত্যাশী ওই প্রার্থীর নাম ফারজানা। ফারজানা ইবির এ বিভাগ থেকেই অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন।
এ দিকে অডিও ফাঁস হওয়ার ঘটনায় আইসিই বিভাগের প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটির সদস্য দুইজন হলেন, ইবি ছাত্র উপদেষ্টা এবং ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. এ এইচ এম আক্তারুল ইসলাম। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
পাঠক মহলের সুবিধার্থে সেই প্রার্থী এবং শিক্ষকদের অডিওর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হুবুহু তুলেধরা হলোÑ
ফারজানা : আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ, দেখ বাবু আমি...
ফারজানা : স্যার আমি তো আপনাদের কথা শুনে অনেকখানি একদম ডিপেন্ডেবল। যে কালকে আপনারা আমাকে এত করে বললেন, জাহাঙ্গীর স্যার যখন বলল যে, আপনাকে, আপনার মাধ্যমে টাকাটাও ডিল-ট্রিল করবে। আপনার কথা শুনে আমি একদম ২০ লাখ টাকাও হাতে ধরায় দিলাম। তুলে দিলাম। আশা করলাম। স্যার কেন এমনটা করল? জাহাঙ্গীর হোসেন স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : এখন আমি তোমার স্যারের সাথে এতক্ষণ বসে থেকেছি... এখন বাবু শোনো...
ফারজানা : স্যার তো সিগনেচার না করলে তো এটা নিয়োগ হতো না। স্যার তো আমাকে বলতে পারত। আমাকে যতি আরো কিছু অ্যামাউন্ট দেয়া লাগত। আমি তাতেও রাজি ছিলাম।
ড. বাকী বিল্লাহ : না না, ওসব না, ওসব না। মনি, ওসব কোনো কিছুই না।
ফারজানা : তাহলে কেন আপনারা আমাকে কনফার্ম দিলেন? আমি রিটেনে ভালো করলাম। আমি ভাইভাতেও ভালো করলাম। আমাকে সব আশ্বস্ব করে দিলেন। আর এখন শেষ মুহূর্তে এসে এমন করলেন আপনারা আমার সাথে।
ড. বাকী বিল্লাহ : সবকিছু ওকে আছে এখন যেটা ঘটনা হলো... এখন কুষ্টিয়া থেকে তোমাকে বলি, হয়তো অন্য কারও হয়েছে বা, যা হোক আমি তো বলতে পারব না।
ফারজানা : কুষ্টিয়ার ক্যান্ডিডেট তো আমিই ছিলাম স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : হুমমম, আরে বাবা আরো ক্যান্ডিডেট আছে। নুসরাত (কুষ্টিয়ার) ক্যান্ডিডেট ছিল না?
এ পর্যায়ে একই ধরনের বেশ কিছু কথা হয় ড. বাকী এবং ফারজানার মধ্যে। শেষের দিকে এসে ফারজানা বলেন,
ফারজানা : আচ্ছা আপনি উনার (ফারজানার স্বামী) সাথে কথা বলেন।
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ।
ফারজানার স্বামী : হ্যালো...।
ড. বাকী বিল্লাহ: হ্যাঁ, মামুন ভাই ভয় পাচ্ছেন কেন? কুষ্টিয়ার ছেলে। আপনি আসেন। আমি তো আপনাকে নিজে পৌঁছে দেবো। কী মুশকিল রে ভাই... মানুষের উপকার করতে গিয়ে আমি নিজেই তো একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছি।
ফারজানা এবং ড. আজাদের অডিও কলের প্রধান অংশ-
ফারজানা : কালকে আপনারা এত কিছু করলেন, আমাকে আশ্বস্ত করলেন, আম্মু তোমার চাকরি হয়ে গছে। তুমি টেনশন করো না।

ড. আজাদ : শোন শোন, সেভাবেই কথাবার্তা ছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীর স্যার (সভাপতি, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ) বললেন অন্যান্য বোর্ডে ভিসি এভাবে রোল প্লে করে না, জোর করে নেয় না। কিন্তু কালকে ভিসি রংপুরের একটা প্রার্থী নিয়েছে।
ফারজানা : কিন্তু স্যার, আমি আপনাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে টাকা পয়সা সব পে করলাম, কথা সব ঠিক চলছিল, স্যার আমিতো টাকা পয়সা দিয়েছি ফেরত নেয়ার জন্য নয়, চাকরি নেয়ার জন্য দিয়েছি। আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে টাকাটা দিয়েছি। আপনারা চেয়ারম্যানের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এটা করবেন। কারণ চেয়ারম্যান (ড. জাহাঙ্গীর) স্যার নিজে আমাকে হ্যান্ডেল করেছে। চেয়ারম্যানের নিজের ক্যান্ডিডেট ছিলাম আমি। সে আপনাদের কথা আমাকে বলেছে, না হলে কি আমি আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছতে পরতাম? আমি সব ডিল করলাম, আমি সব কিছু করলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার আইন বিভাগের প্রফেসর ড. সেলিম তোহা বলেন, ‘নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে শিক্ষক সমাজের সম্পৃক্ততার প্রশ্ন আসলেই আমরা (শিক্ষক সমাজ) লজ্জায় পড়ে যাই। শিক্ষকেরা সমাজে তাদের অবস্থান বুঝতে পারলে এসব অপরাধে জড়িত হতো না। কিছু অসৎ, অতি লোভী শিক্ষকের বিতর্কিত কাজ পুরো শিক্ষক সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অপরাধ মুক্ত করতে।’

ভিসি প্রফেসর ড. হারুন-উর রশিদ আসকারী বলেন, ‘অডিও ফাঁসের তথ্য প্রশানের নজরে এসেছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

 

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/333239