১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৫

ব্যাংকে ঋণ অবলোপন বাড়ছে: জুন পর্যন্ত ৪২ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ অবলোপন

মন্দ ঋণ হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঋণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ অবস্থায় ক্ষতি মেনে নিয়ে ব্যাংকিং খাতে ঋণ অবলোপনের (রাইট অফ) ঘটনা বাড়ছে। গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার মন্দ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এরপর ডিসেম্বর শেষে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ আরও বেড়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব, প্রকাশনার তথ্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের যে তথ্য দেয়া হয়, তাতে শুধু নিয়মিত খেলাপি ঋণকেই দেখানো হয়। অবলোপন করা ঋণকে আড়ালেই রাখা হয় সব সময়। মন্দ মানে শ্রেণীকৃত পুরনো (পাঁচ বছরের বেশি) খেলাপি ঋণ ব্যাংকের স্থিতিপত্র (ব্যালান্সশিট) থেকে বাদ দেয়াকে ‘ঋণ অবলোপন’ বলা হয়। আর ঋণ দেয়ার পর আদায় না হলে তা খেলাপি হয়ে পড়ে। যার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিপুল পরিমাণ এ খেলাপি ঋণ দেশের জন্য অশনিসংকেত। তবে খেলাপি ঋণ যে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, তা স্বাভাবিক। কারণ গত কয়েক বছরে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তা কখনই আদায় হবে না। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান-এমডিরা মিলে দুর্নীতি করেছেন। বেসরকারি ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা আগের প্রান্তিক জুনে ছিল ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এ হিসেবে খেলাপী বাড়ছে। এ ছাড়া গত জুন পর্যন্ত সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৪২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে এক কর্মশালায় ঋণ অবলোপন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, বেঁচে থাকতে হলে যেমন শরীরের টিউমারটা ছেঁটে ফেলতে হয়, তেমনি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি বলেন, অবলোপন যেটা হয়ে গেছে, সেটা আদায় হয়তোবা সময়সাপেক্ষ। তবে এর জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষা মেনে নিতে হয়। কারণ অবলোপনের আগে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর। তবে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ আদায়ে শেষ পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালায় ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এটা মনিটরিং করা হয়।

বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংকে ২০১৫ সালে ঋণ অবলোপন করা হয় ২১৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ২০১৬ সাল শেষে আরও ৩৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়। তবে এ সময় ব্যাংকটি আদায় ও নানাভাবে সমন্বয় করেছে ১৯৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ২০১৬ সালে ঋণ অবলোপন করে ৩৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর আগে ব্যাংকটি ২০১৫ সালে আরও প্রায় ১০ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করে। এসব টাকার খুব সমান্যই আদায় হয়েছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ওই সময় পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণ ছিল আরও ১৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ছিল ৩৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত প্রায় ৮ বছরে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার প্রায় ৬৪ শতাংশ। এর বাইরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আরও ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই সুবিধা পেয়েছে মূলত বড় খেলাপিরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে। ১০ কোটি টাকার নিচে যে কোনো ঋণ ৩ মাসে পরিশোধ করতে না পারলে তা সাব স্ট্যান্ডার্ড বা মোটামুটি ভালো মান, ৬ মাসে পরিশোধে ব্যর্থ হলে ডাউটফুল বা সন্দেহজনক মান ও ৯ মাসে পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাড অ্যান্ড লস বা মন্দ ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
http://www.jugantor.com/industry-trade/2017/02/16/101594/%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%8B%E0%A6%A3-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%9B%E0%A7%87