৭ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ১০:৩৩

চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা চলছে

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

সারাদেশে ভুয়া চিকিৎসকসহ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক ল্যাববাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এদের দুর্ভাগ্যজনক শিকারে পরিণত হচ্ছেন রোগী এবং সাধারণ মানুষ। অবৈধ চিকিৎসাব্যবসা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রায়শ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে। তাও থামছে না এক শ্রেণির ভুয়া ডাক্তার ও মাস্তান চিকিৎসাবণিকের দাপট।
গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টে প্রকাশ, দেশজুড়ে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারের দৌরাত্ম্য এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন বাহারি ডিগ্রির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিরীহ রোগীদের প্রতারিত করছেন তারা। ফলে চিকিৎসাসেবায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোগীদের জীবন। গত জুন পর্যন্ত দুই বছরে সারাদেশে ভুল চিকিৎসা ও ভুয়া ডাক্তারের কবলে পড়ে সাড়ে চার শতাধিক রোগীর করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের ভুল ও গাফিলতিতে ৬৭ জন এবং ঢাকার বাইরে আরও প্রায় ৪০০ রোগীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তাদের ভুল চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়েছে। অল্প সময়েই নিভে গেছে তাদের জীবনের আলো।
বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এর হিসেব অনুসারে শুধু রাজধানীতেই আড়াই হাজারের বেশি ভুয়া ডাক্তার রয়েছেন। সারা দেশে এ সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। তবে বাস্তবে বিএমডিসির দেয়া পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি ভুয়া ডাক্তার দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভুয়া ডাক্তারের পাশাপাশি জাল ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও কম নয়। তাঁরাও এমবিবিএস পাসের পর নামের আগেপিছে দেশ-বিদেশের ভুয়া উচ্চতর ডিগ্রি ব্যবহার করে বছরের পর বছর রোগী দেখছেন। হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ।
ভুয়া ডাক্তার-দালালদের দৌরাত্ম্য, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা আর চিকিৎসাবাণিজ্যের কবলে পড়ে একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছেন। গত কয়েক মাসে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের উদ্যোগে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে অর্ধ শতাধিক ভুয়া ডাক্তার আটক এবং তাঁদের জেল-জরিমানা করা হয়। ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যের কথা স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ নিজেও স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, চিকিৎসা সেক্টরে ভুয়া ডাক্তার ও অপচিকিৎসা ব্যবস্থাটি বছরের পর বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতোই চেপে আছে। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার লক্ষ্যে বিএমডিসি ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই।
ভুল চিকিৎসার নির্মম বলি হয়েছেন সাংবাদিক রুবেলের আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রাইফা। ঠা-াজনিত সামান্য সমস্যা থেকে হাসপাতালে ভর্তি। এরপর ডাক্তার-নার্সের হেয়ালি ইনজেকশন কেড়ে নিল আড়াই বছরের ফুটফুটে মেয়েটিকে। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রায়ই মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে হাতুড়ে ডাক্তার হয়েও সাইনবোর্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয়ে রাজধানীসহ সর্বত্রই প্রতারণাবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফার্মেসিতে মোবাইল কোর্টের অভিযানকালেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিচয়ধারী ৩১ জনকে আটকের ঘটনাও ঘটে। শতকরা ৯০ ভাগ ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তার দ্বারাই বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-নার্সিং হোমের চিকিৎসাসেবা পরিচালিত হচ্ছে। বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভুয়া ডাক্তাররা নামের পেছনে এফআরএসএইচ, এমএসিপি, এফআরসিপি, পিজিটি, এমডি এবং এফসিপিএস (ইনকোর্স) ও পার্ট-১ অথবা পার্ট-২সহ বিভিন্ন ডিগ্রি উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, ভুয়া ডিগ্রির সঙ্গে লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামও লেখা থাকে সাইনবোর্ডে। এ কারণে সাধারণ রোগীরা এসব ডাক্তারকে বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত বলে মনে করেন। এ সুযোগে ভুয়া ডাক্তাররা রোগীপ্রতি ভিজিট নেন পাঁচশ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, দেশে ভুয়া ডিগ্রির অভাব নেই। টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে সব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের জাল সার্টিফিকেট। এটাও অজ্ঞ-অদক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টিতে 'অবদান' রাখছে বলে মনে করছেন বিএমডিসি কর্তৃপক্ষ। সামান্য কিছু টাকা খরচ করলেই যে কেউ হতে পারেন সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ডাক্তার। পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকলেও অসুবিধে নেই। খরচের পরিমাণও নাগালের মধ্যেই। ভারত বা অন্য দেশের সার্টিফিকেট পেতে ১৫/২০ হাজার টাকা খরচ করলেই হয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসঘেঁষা এলাকা থেকে এসব সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে সব মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার দরকার হয় মাত্র। ডেন্টাল কলেজের সার্টিফিকেটের জন্য চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা হলেই চলে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্টিফিকেট পেতে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। এমন উদ্বেগজনক রিপোর্ট ছেপেছে দৈনিকটি। শুধু উদ্বেগজনক নয়, আলোচ্য রিপোর্টে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ভয়াবহ রূপও প্রকাশ পেয়েছে।
কয়েক দিন আগে ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাওয়া যায় সেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ বিপুল পরিমাণ মেডিকাল রিএজেন্ট। এগুলো রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত হতো। এজন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টাররের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে এপোলো, স্কয়ারসহ বিভিন্ন নামিদামি বিশেষায়িত হাসপাতালে অভিযান চালিয়েও মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিকেল, রিএজেন্ট ও ওষুধ পেলে আদালত সংশ্লিষ্টদের জরিমানা করে। কোনও কোনও হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে একই অপরাধ পায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। অর্থাৎ চিকিৎসাসেবার নামে দুইনম্বরি ব্যবসা এমনই পেয়ে বসেছে যে, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের জন্য জরিমানা বা মান-সম্মান জলাঞ্জলি দেয়া সংশ্লিষ্টদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। আমরা কোন দেশ আর কেমন সমাজে বসবাস করছি তা ভাবা যায়?
শুধু বেসরকারি হাসপাতালেই নয়, সরকারি হাসপাতালেরও কোনও কোনওটির বিরুদ্ধে একইরকম বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হয়েছে জরিমানাও। সরকারি হাসপাতালে সীমাহীন দালালি আর অন্যত্র রোগী ভাগিয়ে নেবার অভিযোগতো অনেক পুরনো। ওষুধ চুরি করে কালোবাজারে বেচে দেবার কারবারও অনেক দিনের। এগুলো আর ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না বলা যায়। এছাড়া গ্রামে-গঞ্জে ভুয়া ও ভূঁইফোড় হাজার হাজার হাতুড়ে ডাক্তারতো রয়েছেনই। ভুল চিকিৎসা এবং ডাক্তারের অবহেলায় চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে আড়াই বছর বয়সের একটি শিশু মারা যায় সম্প্রতি। শিশুটির সাংবাদিক বাবা থানায় মামলা এবং তাঁর সহকর্মীরা প্রতিবাদ করলে ডাক্তাররা সাংবাদিকের কোনও সন্তানের চিকিৎসা করবেন না বলে প্রকাশ্যে হুমকি দেন।
বিএমডিসি'র দেয়া তথ্যমতে যদি ঢাকায় আড়াই সহস্রাধিক এবং সারাদেশে বিশ হাজারের বেশি ভুয়া ও জাল সার্টিফিকেটধারী ডাক্তার চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় বলা যায় তাঁরা গণহত্যাই চালাচ্ছেন। প্রতিদিন রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে অঢেল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে জীবনের পরিবর্তে দিচ্ছেন মর্মান্তিক মৃত্যু উপহার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই হচ্ছে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র। এবার বলুন, আমরা কোথায় যাই আর দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি রোগীদের আস্থা-ই বা থাকে কী করে? তাই অবিলম্বে অবৈধ চিকিৎসাবাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

 

http://www.dailysangram.com/post/336890-