৬ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১:০০

কেউ হাসপাতালে কেউ কারাগারে অনিশ্চয়তায় সবাই

হাতুড়ির আঘাতে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তরিকুল। ছাত্রলীগের হামলার কথা বলতে গিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তরিকুল বলছিলেন, ‘ওদেরকে অনুরোধ করছিলাম, আর যেন না মারে। কেউ আমার কথা শুনলো না। যাদের হাতে লাঠি ছিল সবাই পেটাচ্ছিল। খুব কাছ থেকে যেন দেখছিলাম মৃত্যুকে। কী নির্দয়ভাবেই না পেটাচ্ছিল আমাকে! কোনো মানুষ মানুষকে পেটাতে পারে এভাবে, কল্পনাও করিনি কোনোদিন।

একপর্যায়ে জীবনেরই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবে ছিলাম আর হয়তো বাঁচবো না।’ কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভের সময় গত সোমবার তরিকুলকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে রাস্তায় ঘিরে ধরে পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন মিলে যখন লাঠি নিয়ে তরিকুলকে পেটাচ্ছিল তখন ছাত্রলীগের কর্মী আবদুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার পিঠে ও পায়ে আঘাত করে।

কাঠের উপর যেভাবে পেরেক ঠোকা হয়, সেভাবে তরিকুলের শরীরে আঘাত করা হচ্ছিল হাতুড়ি দিয়ে। তরিকুল এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। শুধু তরিকুলই নন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর। তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে অনেকটা গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা পাননি দাবি করে নূর জানিয়েছেন, তিনি এখন যে হাসপাতালে ভর্তি আছেন সেখান থেকেও বের করে দেয়া হয়েছিল। তারা তার চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করে। হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে জানাজানি হওয়ার পর তারা আবার আমার চিকিৎসা দিচ্ছে। কোটা আন্দোলনের দুই যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান ও রাশেদ খান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। রাশেদ খানকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এছাড়া সামনের সারির অন্য নেতারা আছেন গ্রেপ্তার ও হামলার আতঙ্কে। কোট সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বলছেন, আন্দোলনে জড়িত সামনের সারির নেতারা কেউ হাসপাতালে, আবার কেউ কারাগারে। বাইরে যারা আছেন তারা আছেন আতঙ্কে। এমন অবস্থায় সবাই একটা অনিশ্চিয়তা নিয়ে সময় পার করছেন।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা মানববন্ধন করার সময় আন্দোলনের যুগ্ম-আহ্বায়ক ফারুক হোসেনকে মারধরের একপর্যায়ে শাহ্বাগ থানায় নিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে তাকে একটি পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে বা মামলা মাথায় নিয়ে কারাগারে যাওয়া নেতাদের দায়িত্ব নিতে চাইছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রেপ্তার ছাত্রদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘গ্রেপ্তার আছে নাকি? যা হবে আইনি কাঠামোর মধ্যেই হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় ১৮ বছর বয়স হলে ব্যক্তিকে তার নিজের দায়দায়িত্ব নিতে হয়। সবার জন্যই এই আইন প্রযোজ্য।’ তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের কাঁধে ভর দিয়ে যেন কোনো অশুভ শক্তি তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিনষ্ট করার কোনো অপপ্রয়াস সহ্য করা হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ছাত্রদের গ্রেপ্তার, তাদের ওপর হামলার বিষয়গুলো এড়িয়ে চলেন। প্রক্টর গোলাম রব্বানী ছাত্রদের এ আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা। তা ছাড়া তাঁরা শিক্ষা কার্যক্রম ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টা দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানে।

পুলিশ বুধবার পর্যন্ত ১০ জনের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- রাশেদ খান, ফারুক হোসেন, তরিকুল, জসিমউদ্দিন, মশিউর, আমানুল্লাহ, মাজহারুল, জাকারিয়া, রমজান ওরফে সুমন ও রবিন। তাদের মধ্যে তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এরমধ্যে একজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, আন্দোলনে যুক্ত হলে হলছাড়া করা হবে, এমন হুমকি দিয়ে ছাত্রদের চুপ করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র একরামুল হককে হল থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আইন অনুষদের ছাত্ররা বলছিলেন, তারা ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবারের এই পেজ থেকে ক্লাস বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আইন অনুষদের ঠিক উল্টো পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে তারা এই কর্মসূচি নিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তারা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার জন্য হুমকি পাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের নেতারা একরামুল হককে বের করে দেন।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=124436