৬ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১২:৫৬

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

ঢাকায় যানজটে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা

বিশ্বব্যাংক মনে করে, ঢাকায় যানজটের কারণে গত ১০ বছরে গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। যেখানে পায়ে হেঁটে চলার গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। শুধু এই যানজটের কারণেই ঢাকায় দিনে ৩২ লাখ কর্ম ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া ঢাকাকে আরো বসবাস উপযোগী, রাজধানীবাসীর আয় বৃদ্ধি এবং ঢাকার আধুনিকায়নের পরামর্শ দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলছে, ঢাকা মহানগরীর দ্রুত সমপ্রসারণের সঙ্গে নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। ফলে একটি বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এমনটি অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালের পর নগরীর অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে।
তবে বিশেজ্ঞদের পরামর্শমতো এখনই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করলে ঢাকাকে বিশ্বমানের নগর হিসেবে গড়ার পাশপাশি নাগরিকদের আয় বাড়ানোও সম্ভব।

বিশ্বব্যাংকের ‘টুওয়ার্ড গ্রেটার ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডিগেম ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঢাকার এ চিত্র তুলে ধরা হয়। গতকাল রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। গ্লোবাল সিটির অংশ হিসেবে ঢাকাকে কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, গবেষণায় তাও দেখানো হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফানের সভাপতিত্বে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা, পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর অ্যান্থনি ভেনাবল। এছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বক্তব্য দেন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ঢাকার পূর্বাংশ উন্নয়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বন্যা, ঘনবসতি এবং বিশৃঙ্খলা দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দারুণ সুযোগ রয়েছে। ঢাকা শহরের সম্ভাব্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৌশলগত দিকের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে এতে।

সাংহাই এর সাফল্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এবং স্থানীয় অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনে পূর্ব ঢাকার উন্নয়নের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। সুপারিশ তিনটি হচ্ছে- বন্যা প্রতিরোধে বালু নদীর পাশে পূর্ব বাঁধ নির্মাণ, যানজট কমাতে পরিবহন সংযোগ এবং গণপরিবহনের উন্নয়ন এবং পূর্বাংশের সংস্থা ও বাসিন্দাদের আকৃষ্ট করতে একটি বিশ্বমানের ব্যবসায়িক জেলা তৈরি করা। প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কীভাবে এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা একটি বিশ্বমানের শহরে পরিণত হতে পারে এবং এটি বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক এলাকা হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বব্যাংক জানায়, এগুলো গৃহীত হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকায় মাথাপিছু গড় আয় ৯ হাজার ২০০ ডলার হবে।

বিশ্ব ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট মার্টিন রামা বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও যানজটের সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় ঢাকার বাসিন্দারা বর্তমানে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি বলেন, কৌশলগত পদ্ধতির সঙ্গে পূর্ব ঢাকা উন্নয়নের মাধ্যমে এটি আরো সমৃদ্ধ এবং বাসযোগ্য শহর হবে। কিন্তু অতীতের উন্নয়নে পুনরাবৃত্তি এড়াতে এবং পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি কমানোর জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। না হলে ভবিষ্যতে পূর্ব ঢাকার উন্নয়ন করা আরো ব্যয়বহুল ও কঠিন হবে।

তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ৩০ লাখ ছিল। সে অবস্থা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮০ লাখ। এদের মধ্যে ৩৫ লাখ বাসিন্দা বর্তমানে বস্তিতে বাস করে যারা মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। শহরের উন্নয়নের জন্য ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সামাজিক অবস্থা আরো খারাপ হবে। বর্তমান প্রবণতার কারণে ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকায় বাস করবে আড়াই কোটি মানুষ। ঢাকার বস্তিবাসীরা গ্রামের সাধারণ ব্যক্তির চেয়ে বেশি আয় করে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ জন্য ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা চাইলেও কমানো যাবে না বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

তিনি বলেন, ঢাকা শহরের বর্তমান সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য ট্রান্সপোর্ট লিংক, পাবলিক ট্রানজিট এবং ওয়ার্ল্ড ক্লাস বিজনেস নামক তিনটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকা শহরে নতুন করে আরো অতিরিক্ত ৫০ লাখ লোক বসবাসের সুযোগ পাবে। আরো ১.৮ মিলিয়ন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা যাবে। আর তা থেকে অর্থনৈতিকভাবে ২০৩৫ সালের মধ্যে আয় করা যাবে ৫৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। যার নির্মাণ ব্যয় হবে মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার। তাই সরকারের উচিত আমাদের এই প্রকল্পগুলোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা। তিনি বলেন, অধিক লোকসংখ্যা ও যানজটের কারণে বর্তমানে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন ঢাকাবাসী। কিন্তু পূর্ব ঢাকায় নগরায়ন করা হলে সেখানে সুপরিবেশে একটি মানসম্মত এলাকা তৈরি করা যাবে। তবে এজন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিও ফান বলেন, ঢাকার বৃহৎ অবস্থানগত কারণে একে মেগাসিটি করার জন্য ঢাকার পূর্বাচল একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এ জন্য সুচিন্তিত প্রস্তাব, পারস্পারিক সাহায্য ও যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হবে। চিমিও ফান বলেন, যে নতুন তিনটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, এর ফলে ৫০ লাখ লোকের বাসস্থান ও প্রায় ১৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এগুলো বাস্তবায়নে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। কিন্তু এর ফলে ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া জনজীবনেও এর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিশ্বব্যাংক বৃহত্তর ঢাকার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার ও জনগণের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

অনুষ্ঠানে অ্যান্থনি ভেনাবল বলেন, গড় হারে প্রতিদিন ঢাকায় মানুষ বাড়ছে। বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা হবে সাড়ে ৩ কোটি। ঢাকা এখন প্রচুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সেটা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এটা একটা ভালো রিপোর্ট। কীভাবে ঢাকাকে আরো বসবাস উপযোগী করা যায় এখানে সেটা দেখানো হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। তবে অর্থায়নে সমস্যা হবে না। সমস্যা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা। কারণ এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা লাগে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে সুপরিকল্পনা নেয়া হলেও থেমে যায় অনেক উদ্যোগ। তাই বেশি প্রতিষ্ঠানের উপর দায়িত্ব না দিয়ে সক্ষম কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হলে পূর্ব ঢাকাকে আধুনিক ঢাকায় রূপান্তর করা যাবে বলে জানান তিনি।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সঠিক পরিকল্পনা, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ভূমি নিয়ন্ত্রণ- এসব ক্ষেত্রে রাজউক ব্যর্থ হচ্ছে। তাই সঠিক নগরায়ন গড়ে উঠছে না। তিনি বলেন, ঢাকার উন্নয়নে দেশের ১১টি মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৫৪টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এতো প্রতিষ্ঠান না করে যদি ২/১টি প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাহলে কাজে গতি আসবে। সফলভাবে কাজ সম্পন্ন করা যাবে। কিন্তু রাজউক শুধু পরিকল্পনাই করছে। জমি কিনে কতিপয় গোষ্ঠীর জন্য ফ্ল্যাট তৈরির কাজ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। এ ছাড়া ঢাকা থেকে কাজ করে নিজ অঞ্চলে ফিরতে পারে এমন ব্যবস্থা করার তাগিদ দেন ইকবাল হাবিব।

স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, পূর্ব ঢাকাকে নগরায়ন করতে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার দরকার। ঢাকার উন্নয়নের সঙ্গে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন সমস্যা রয়েছে। তবে ভিশন ২১ বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, ঢাকার উন্নয়ন হলে পুরো দেশের উন্নয়ন হবে। এজন্য ঢাকার উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। এ জন্য বর্তমানে প্রতিটি জেলায় কর্মসংস্থান ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। ফলে ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কিছুটা হলেও কমবে। তবে ঢাকার উন্নয়নে সকল প্রস্তাবনাই বিবেচনা করা হবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=124439