৪ জুলাই ২০১৮, বুধবার, ১১:০২

চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী

ভরা মৌসুম। চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ বেশি; কৃষকরা চালের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না; অথচ চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মূলত সিন্ডিকেটের দৌড়াত্বেই বাড়ছে চালের দাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের বাজারের সিন্ডিকেট কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি করেছে। ‘চাল নিয়ে চালবাজি’ ঠেকাতে সিন্ডিকেট ধ্বংসে গত বছর খাদ্য মন্ত্রণালয় ১৬ হাজার চালকলকে কালো তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন দলের রাঘব-বোয়ালদের আশীর্বাদ থাকায় প্রশাসনযন্ত্র চেষ্টা করেও সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। গত ৭ জুন প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর পরই সক্রিয় হয়ে ওঠে অসাধু সিন্ডিকেট। ঈদের পরপরই সব ধরনের মোটা চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। অথচ বিশ্ববাজারে তিন সপ্তাহ আগে প্রতি টন চালের দাম ছিল ৪৩৫ ডলার বা তার উপরে। কিন্তু এখন তা কমে ৪০০ ডলারে নেমেছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চালের দাম কমেছে ৩৫ থেকে ৪০ ডলার। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশে চালের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে।

বিক্রেতারা বলছেন, চাতাল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়ায় এবং সরবরাহ কম থাকয় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর ব্যবসায়ীদের অজুহাতÑ বাজেটে চাল আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা, বিনা খরচে এলসি খোলার সুবিধা বাতিল হওয়া এবং সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষক ও চাল উৎপাদকরা যেন ধানের ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিতে চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলায় শর্তজুড়ে দেয়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে। যদিও বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে চাল ধরে রেখেছেন। এ কৃত্রিম সঙ্কটে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে ধানের দামও। অসময়ে ধানের দাম বাড়ায় কৃষকেরা হয়েছেন বঞ্চিত। কারণ কয়েকদিন আগেও মিলারদের কাছে আমদানিকৃত বাড়তি চাল থাকায় কৃষকের কাছ থেকে তারা ধান কেনায় আগ্রহী হননি। এতে ফরিয়াদের স্বল্পমূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। এদিকে বিক্রেতারা, চালের দাম আরও বাড়ার আভাস দিয়েছেন। ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাময়িক অসুবিধায় শুল্ক কমানো হলেও এটি যখন বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, তখন তা করা হয়নি। এতে অতিরিক্ত চাল আমদানি করে ফেলে ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে।

সূত্র মতে, হাওরে ফসলহানির কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১০ লাখ টন কম চাল উৎপাদন হয়। এই অজুহাতে চালের দাম বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার সামাল দিতে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে সরকার তিন দফায় কমিয়ে চালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে। এতে চালের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও এখন আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। আর শুল্ক প্রত্যাহারের সুযোগে প্রচুর চাল আমদানি হয়, যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। আগের অর্থবছর ৫৮ লাখ ২৩ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি হলেও বিদায়ী অর্থবছরে তা পৌঁছে কোটি টনে। ব্যবসায়ীরা ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে এই চাল আমদানি করেন।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেছেন, চাল আমদানিতে উৎসাহিত করাই কৃষকের ক্ষতির অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, শুল্ক ছাড়ের কারণে অনেক নিয়ম-নীতি পাশ কাটিয়ে চাল আমদানি করা হয়েছে। আর যদি তা না হয়, তাহলে চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্যে গরমিল আছে। সাময়িক অসুবিধায় শুল্ক কমানো হলেও এটি যখন বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, তখন তা করা হয়নি। তাই চলমান বোরো মৌসুমে মিলারদের কাছে বাড়তি চাল থাকায় কৃষকের কাছ থেকে তারা ধান কেনায় আগ্রহী হননি। এতে স্বল্পমূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষক। আর বেশি দামে চাল খেতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে।

পাইকারি বাজারের চাল বিক্রেতারা বলছেন, বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে তা ধরে রেখেছেন। এ কৃত্রিম সঙ্কটে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। গতকাল রাজধানীর শান্তিনগর, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর ও হাতিরপুলসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে এ প্রবণতা দেখা গেছে। মোটা চাল মানভেদে ৪০ থেকে ৪৮ টাকা ও চিকন চাল ৫৮ থেকে ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, উন্নতমানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল ৬০-৬৬ টাকা, পাইজাম ও লতা ৪৮-৫৪ টাকা এবং স্বর্ণা ও চায়না ইরি ৩৮-৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। কাপ্তান বাজারের নুরু রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী নুরু মিয়া বলেন, বাদামতলীর পাইকারি বাজারে চালের দাম বেশি। আর এ কারণে খুচরা বাজারেও চালের দাম বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বাড়ছে আমদানিকৃত চালের দাম। বাজেটে সরকার নতুন করে কর বাড়ানোর ফলে চালের দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি।

ঢাকার বাদামতলী বাজারে নাজিরশাইলের বস্তা ২৭৫০-২৯০০ টাকা, মিনিকেট ২৬০০-২৭৫০ টাকা, বি আর-২৮ চাল ২১০০-২১৫০ টাকা এবং বি আর-২৯ হাসকি (অর্ধসিদ্ধ বি আর-২৮ চাল) ২০০০-২১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজারে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা নাজিরশাইল ২৮০০-৩০০০ টাকা, মিনিকেট ২৭০০-২৮০০ টাকা এবং বি আর-২৮ চাল ২১০০-২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজেটে পূর্বের মতো ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের ঘোষণার পরপরই সরবরাহ পর্যায়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটচক্র পরিকল্পিতভাবে সরবরাহ চেইনে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছেন। চাল ব্যবসায়ীদের মতে, শুল্ক পুনর্বহালে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয় রাখতে ব্যবসায়ীরা সারাবছর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে নিয়মিত চাল আমদানি করে থাকেন। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা চালের দাম বৃদ্ধির হুজুগে দেশে উৎপাদিত চালের দামও বাড়ছে প্রায় একই হারে। এর প্রভাব পড়েছে সারাদেশে চালের পাইকারি বাজারে। খুচরা বাজারে দামের উত্তাপ আরও বেশি। যদিও বাজার স্থিতিশীল রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয় খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচি চালু করলেও তা চলছে সীমিত পরিসরে। শুধু রাজধানী, কয়েকটি শ্রমঘন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে চলছে এ কর্মসূচি। বরাদ্দ কমানো হয়েছে ডিলারদের।
খাদ্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, সরকারি গুদামে খাদ্যশষ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় সরকার এবার আমদানি না করে দেশের ভেতর থেকেই চাল সংগ্রহ করবে। আরও ৫-৬ মাস চালের কোনো সমস্যা হবে না, আমদানিরও দরকার হবে না। তবে আমদানি শুল্ক বাড়ায় বাসমতি ও ভালো মানের চিকন চালের দাম বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৩ লাখ ২৩ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার টন গম। এছাড়া খালাসের অপেক্ষায় বন্দরে আছে ৫২ হাজার টন খাদ্যশস্য।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, সরকার চায় কৃষক ধানের দাম পাক, কৃষক দাম পেলে চালের দাম তো বেশি হতেই পারে। নতুন করে শুল্ক আরোপের পর আর চাল আমদানি হচ্ছে না জানিয়ে লায়েক আলী বলেন, এই সময়ে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। নির্বাচন নিয়ে সরকার সচেতন আছে, কৃষক না ভোক্তাদের সুবিধা দিয়ে তাদের লাভ হবে তা তারা ভালো বোঝেন। এ নিয়ে আমরা কিছু বলতে চাই না। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে চাল বিক্রি করি।

এদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর সব কটি ধানের মৌসুমে দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে ৬৫ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সরকারের খাদ্য গুদামে এখন ১০ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ আছে। স্থানীয় বাজার থেকে আরও কেনা হচ্ছে নয় লাখ টন চাল ও এক লাখ টন ধান। অন্যদিকে গত এক বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ লাখ টন দেশে বাজারজাত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া গত জুন পর্যন্ত সময়ে আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪৬ দশমিক ৪৩ লাখ টনের। এসব চাল শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়ে আমদানি করা হয়েছে। এই অবস্থায় চালের দাম বাড়ার কোন যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

https://www.dailyinqilab.com/article/139694