৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:০৫

শিশু অপহরণে ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট

টার্গেট তাদের ঘনবসতি এলাকা। যেখানে বসবাস নিম্ন আয়ের মানুষের। এমন এলাকাকেই বেছে নিয়েছে তারা। গড়ে তুলেছে ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে একাধিক নারী সদস্য। রয়েছে দালাল। তাদের টার্গেট ৫ থেকে ৭ বছর বয়সী শিশু। কৌশলও অভিনব। প্রথমে ওই এলাকায় গিয়ে বসবাস। এরপর নিজ শিশু সন্তানকে টার্গেট শিশুর সঙ্গে খেলতে দেয়া। এক সময় নিজেই ঘনিষ্ঠ হওয়া। বেড়াতে বা অন্য কোনো প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করা। এরপর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে রাখা। প্রথম ধাপের এই কাজটি করেন সিন্ডিকেটের নারী সদস্যরা। পরবর্তী ধাপ মুক্তিপণ আদায়। দালাল সেজে সন্তানকে পাইয়ে দিতে মূল অপহরণকারীর সঙ্গে মধ্যস্থতা করে সিন্ডিকেটের স্থানীয় সদস্যরা। মামলা করতেও নিরুৎসাহিত করে সিন্ডিকেটের এই অংশটি। রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী এবং কদমতলী এলাকায় এমন একটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম। খুব দ্রুত সিন্ডিকেটটির মূল হোতাসহ অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তারা। এদিকে ৩রা ফেব্রুয়ারি ওই সিন্ডিকেটের কবল থেকে জোনাকী নামের ৭ বছরের এক শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন অব ব্যুরোর সদস্যরা। এর দু’দিন আগে জোনাকী অপহরণের শিকার হয়। এ ব্যাপারে শিশুটির বাবা স্বপন ডেমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরির সূত্র ধরেই বিশাল এই শিশু অপহরণকারী সিন্ডিকেটের সন্ধান পায় পিবিআই। শুধু একটি বা দুটি নয় ওই এলাকায় এ ধরনের অসংখ্য সিন্ডিকেট রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তালুকদার।
সূত্র জানায়, জোনাকীরা সপরিবারে ডেমরা থানার বাঁশেরপুল এলাকার তাজমহল রোডের মতিন সাহার বাড়িতে ভাড়া থাকেন। তিনি ওই এলাকাতে প্রায় ২০ বছর ধরে বসবাস করছেন। গত ১লা ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টার দিকে বাড়ির পাশের রাস্তায় খেলাধুলা করার সময় জোনাকীকে কৌশলে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। ভিকটিমের পরিবার বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান না পাওয়ায় বিষয়টি এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই দিনই শিশুটির বাবা মো. স্বপন ডেমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরি নং-৪৩। পরে অপহরণকারী চক্রটি ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরদিন ২রা ফেব্রুয়ারি স্বপন ঢাকা মেট্রোপলিটন পিবিআই অফিসে এসে তার শিশু সন্তান নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানান। এ সময় পিবিআই বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ ঘটনাটি শুনে এটি অপহরণ বলে ধারণা করেন। এরপর শিশুটি উদ্ধারে এবং অপহরণকারীর সন্ধানে নামে পিবিআই। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে পিবিআই-এর একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এরপর মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে খিলগাঁও এলাকার শেখেরটেক, নন্দীপাড়া বাজার, ডেমরা এলাকার সারুলিয়া এবং ঘরভাঙ্গায় অভিযান চালায়। অভিযানে অপহরণকারীকে ধরতে না পারলেও শুক্রবার (৩রা ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঘরভাঙ্গা এলাকার ব্রিজের সামনে থেকে অপহৃত জোনাকী (৭) কে উদ্ধার করে। উদ্ধারের পর জোনাকী জানায়, তাজমহল রোডের ভাড়াটিয়া মহিলা রাবেয়া ভ্যানগাড়িতে করে বেড়ানোর কথা বলে তাকে নিয়ে যায়। পরে একটি অন্ধকার ঘরে তাকে আটকে রাখে। সেখানে সে ছাড়াও আরো ২ শিশু ছিল। কান্নাকাটি করলে অপহরণকারীরা তাকে মারধর করতো, বিক্রি করে দেয়ার ভয় দেখাতো। পিবিআই সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে তারা জানতে পেরেছে, অপহরণকারীর সক্রিয় সদস্য রাবেয়া একজন স্বামী পরিত্যক্তা নারী। সে এবং তার অপরাপর সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় কমদামে বাসা ভাড়া নিয়ে শিশু বাচ্চাদের টার্গেট করে। সেখানে ১-২ মাস বাসা ভাড়া থেকে টার্গেটে রাখা শিশুটিকে অপহরণ করে অজ্ঞাতস্থানে চলে যায়। পরে মুক্তিপণ আদায় করে অপহৃত শিশুকে ফেরত দেয়। পিবিআই সূত্র জানায়, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী এবং কদমতলী থানা এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের ঘনবসতির সুযোগে অপরাধ চক্রের মূল হোতারা বিভিন্ন নারী সদস্যদেরকে ব্যবহার করে শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণের বিনিময়ে অর্থ আদায় করে থাকে। শিশু অপহরণের পর স্থানীয় দালাল চক্র আলোচনার মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে অপহৃত শিশুকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। এসব এলাকায় সংঘবদ্ধ দালাল চক্র অপহৃতের পরিবারকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে মামলা করতে নিরুৎসাহিত করে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব এলাকায় এর আগেও বেশ কয়েকটি শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তারা মামলা দায়ের না করে স্থানীয় দালাল চক্রের আশ্রয় নিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে ওই ঘটনায় অপহরণ সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্যকে চিহ্নিত করেছে পিবিআই দল। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে পিবিআই’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ওই এলাকাতে শিশু অপহরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়, অনেক আগে থেকেই শিশু অপহরণের জন্য এলাকাটি ভয়ঙ্কর জোন। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে একেবারে নরসিংদী পর্যন্ত। তিনি বলেন, এদের বিশাল চক্র রয়েছে। শুধু একটি বা দুটি নয় বরং অসংখ্য শিশু অপহরণ সিন্ডিকেট রয়েছে এসব এলাকায়। সালাউদ্দিন তালুকদার এ ধরনের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি তাদের সচেতন হওয়ারও পরামর্শ দেন। শিশু জোনাকীর অপহরণকারীদের মূলহোতা রাবেয়াকে ধরতে অভিযান চলছে জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আশা করি দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=52460&cat=2/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A7%9F%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1