৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৮:০০

গরিবের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে রাজধানী

ভোগের পাশে বঞ্চনা-১

ঐতিহাসিক শহর রাজধানী ঢাকা দিনে দিনে সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই নগরীতে এমন বহুলোক বসবাস করে যাদের জীবনযাত্রার মান বিশ্বের যেকোনো উন্নত দেশের নাগরিকদের সাথে তুলনা করা যায়। তাদের জীবনে ভোগ ও ঐশ্বর্যের কোনো ঘাটতি আছে এমন বলাটা অন্যায় হবে। কিন্তু এটাই এই শহরের একমাত্র চেহারা নয়। বরং অন্য দৃশ্য। অত্যন্ত করুণ। সম্পদ ও শ্রেণীবৈষম্যের কারণে এ দৃশ্য দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। তাই স্বল্প আয়ের গরিব মানুষের জীবন ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকায়। জীবনযাপনের ব্যয় যেভাবে দ্রুত বাড়ছে সে অনুসারে আয় বাড়ছে না অনেকের। দিন দিন জীবনের মান নি¤œ থেকে নি¤œতর হচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষের। যেসব পরিবারে সদস্য বেশি, একাধিক সন্তান লেখাপড়া করছে তারা রয়েছেন শোচনীয় অবস্থায়। রাজধানীতে পরিবার-পরিজনের সাথে গ্রামে বসবাসরত মা-বাবা ও ভাইবোনদের খরচও অনেককে বহন করতে হয়।

রাজধানীতে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের প্রধান সমস্যা বাড়িভাড়া। জিনিসপত্রের সাথে সাথে প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া। এর মধ্যে ছোট শিশুদের প্রায়ই লেগে থাকে জ্বর, নিউমোনিয়া, টাইফয়েডসহ নানা ধরনের অসুখ। এসব খরচ মেটাতে সীমিত আয়ের মানুষ প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকের মাস শেষ হওয়ার আগে শেষ হয়ে যায় মাসের খরচ। এটি ঘটছে অনেকের নিয়মিত। অনেকের বাকি পড়ছে বাড়িভাড়া। অনেকে নানা করণে হচ্ছেন ঋণগ্রস্ত। অনেকে অসুখ-বিসুখে সঠিক চিকিৎসা করাতে পারছেন না। জীবনযাত্রার খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অনেকে জীবন থেকে বাদ দিয়েছেন অনেক খরচ, স্বাদ আহলাদ। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথাও বেড়ানো, পরিবারে মাঝে মধ্যে বিশেষ খাবারের আয়োজনের কথা আর ভাবতে পারছেন না অনেকে। আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্কুলান করতে না পেরে কেউ কেউ পরিবার-পরিজন পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। আবার অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় পরিবার নিয়ে আসতে পারছেন না। ঢাকায় বাসাভাড়া নিয়ে পরিবারসহ বসবাসের সামর্থ্য নেই অনেকের। যদিও চাকরি বা ব্যবসা উপলক্ষে বছরের পর বছর অনেকে বাস করছেন ঢাকায়। অনেকে পরিবারের চাহিদা মেটাতে দিনরাত একাধিক কাজ করেও অভাব আর টানাটানি থেকে মুক্ত হতে পারছেন না।

রাজধানীতে সীমিত আয়ের মানুষের পরিবারে প্রতিনিয়ত চলছে নানা ধরনের টানাপড়েন। অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে পরিবার ও সমাজে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় অনেকের জীবন বিষিয়ে উঠছে। দীর্ঘদিন ঢাকায় বসবাসের কারণে, সন্তানের লেখাপড়াসহ নানা কারণে অনেকে চাইলেও আর গ্রামে ফিরতে পারছেন না।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নজরুল ইসলাম বাস করেন ঢাকার সিপাহিবাগ টেম্পোস্ট্যান্ড এলাকায়। নজরুল ইসলামের চার ছেলেমেয়ে। গত ৩০ বছর ধরে তিনি ঢাকায় বসবাস করছেন। লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় আসেন। এমএ পাস করার পর আর গ্রামে ফিরে যাননি। রাজধানীতেই চাকরি নিয়ে জীবনযাপন শুরু করেন। নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রামে তার বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছেন। তাদের খরচ পাঠাতে হয় প্রতি মাসে। নজরুল আক্ষেপ করে বলেন, নিজের পরিবারের খরচসহ যাবতীয় ব্যয় মেটাতে মাসে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করতে পারলে মোটামুটি সম্মানজনকভাবে ঢাকায় বাস করা যেত পরিবার-পরিজন নিয়ে। কিন্তু তার বেতন এর অনেক নিচে। তাই বাধ্য হয়ে কম খরচের ছোট বাসায় বসবাস করছেন কষ্ট করে। তিন ছেলেমেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় ভালো করার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ তিনি বহন করতে পারেন না। এর মধ্যে ছোট দুই ছেলেমেয়ের প্রায়ই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকে। গ্রাম থেকে চিকিৎসাসহ নানা কাজে আত্মীয় স্বজন আসেন, যা বেতন পাই তা প্রায়ই মাস শেষ হওয়ার আগেই খরচ হয়ে যায়। বাড়িভাড়া যেভাবে বাড়ে আর বাড়িওয়ালাদের যে বিড়ম্বনা তাতে মনে হয় ঢাকায় যদি নিজের একটু জমি থাকত এবং তাতে টিনের ঘর বানিয়েও থাকতে পারতাম তাতে এ অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারতাম। কিন্তু ২০ বছর ধরে চাকরি আর ১৬ বছর ধরে সংসার করেও কোনো টাকা-পয়সা জমাতে পারিনি। গ্রাম বা ঢাকা কোথাও জমি কেনার কথা ভাবতেই পারছি না। টানাটানি থেকেই আজ পর্যন্ত মুক্ত হতে পারলাম না। দিন যতই যাচ্ছে সমস্যা ততই বাড়ছে। ১৬ বছর আগে যখন বিয়ে করে ঢাকায় সংসার শুরু করি তখন জিনিসপত্রের দাম এত ছিল না। দৈনন্দিন বাজার খরচ ছিল তখন খুকই কম, যা এখন ভাবাই যায় না। বাড়িভাড়াও অনেক কম ছিল। শুরুতে সংসার জীবন মোটামুটি ভালোই ছিল। আশা করেছিলাম সামনের দিন আরো ভালো হবে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে ততই টানাটানি যেন বেড়েই চলছে। বাড়িভাড়া, জিনিসপত্রের দাম, চিকিৎসা, লেখাপড়া, পরিবহনসহ সব খাতের খরচ যেভাবে দিন দিন বাড়ছে সে অনুসারে আমাদের বেতন বাড়েনি।

সেলিম শরীফের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায়। সেলিম দিলকুশার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী পদে চাকরি করেন ১৫ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে। থাকেন সিপাহিবাগ বাজার সংলগ্ন ভূঁইয়াপড়া রোডে। গত ১৬ বছর ধরে ঢাকা আছেন সেলিম। সেলিমের এক ছেলে, এক মেয়ে। ১৫ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে সংসার চলে না সেলিমের। নিজের পরিবার ছাড়া গ্রামের বাড়িতে মাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। পাশাপাশি বড় ভাইয়ের সংসারেও সাহায্য করতে হয়। কারণ হিসেবে সেলিম জানান, বড় ভাই অসুখে মারা গেছেন কিছুদিন আগে দুই ছেলে আর দুই মেয়ে রেখে।
সেলিম জানান, নিজের সংসারসহ যাবতীয় খরচ চালাতে অফিসে চাকরির পাশপাশি একটি ফার্নিচারের দোকান দিয়েছেন ভূঁইয়াপাড়া রোডে। পুরনো ফার্নিচার কেনাবেচা করেন। নতুন ফার্নিচারও বানান অর্ডার পেলে। তবে সারা দিন দোকান খোলা রাখতে পারেন না। অফিস থেকে এসে বিকেলে দোকান খোলেন। রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এভাবে সারা দিন অফিস শেষে বিকেল থেকে রাত অবধি দোকান চালাতে হচ্ছে পরিবারের খরচ মেটাতে। সেলিম বলেন, আগে তার পরিবার ঢাকায় ছিল। মাঝে মধ্যে বৃদ্ধ মাও পরিবারের সাথে থাকতেন। কিন্তু গত এক বছর আগে বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে। কারণ মা বৃদ্ধ। তা ছাড়া ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি।

সেলিম জানান, আমাদের সারা দিনরাত শুধু একই চিন্তাÑ কিভাবে অভাব দূর হবে। কিন্তু অভাব আর দূর হচ্ছে না। জীবন ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সমস্যা শুধু বাড়ছে একের পর এক। প্রতিনিয়ত সমস্যার মধ্যে খুরপাক খাচ্ছি আমরা। ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি না। ভবিষ্যতের কথা ভাবলে মনটা ভরে যায় হতাশায়। চোখে শুধু আঁধার দেখি। এভাবেই কি অভাব আর টানাটানির মধ্যে কেটে যাবে আমাদের সারা জীবন। এ থেকে কি আমরা মুক্ত হতে পারব না? জীবনে কি স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পারব না আমরা?

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/328867