গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০১৮ প্রকাশ উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন এডভোকেট সুলতানা কামাল
৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৭:৫৭

তিন বছরের মধ্যে এবারই ঈদ যাত্রায় ঘটেছে সবচেয়ে বেশী দুর্ঘটনা

# যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন প্রকাশ
স্টাফ রিপোর্টার : ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এবারের ঈদুল ফিতরে। মাত্র ১৩ দিনে অকালে ঝরে গেছে ৪০৫ প্রাণ। এর মধ্যে সারা দেশে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক হাজার ২৬৫ জন। একই সময়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ৩৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে ৪০৫ জন নিহত হয়েছেন। আর এক হাজার ২৭৪ জন আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করে। গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট সুলতানা কামাল, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

ঈদযাত্রা শুরুর দিন ১১ জুন থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা, অর্থাৎ ২৩ জুন পর্যন্ত মোট ১৩ দিনের দুর্ঘটনার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সংগঠনের মহাসচিব। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এবারের ঈদের আগে যাত্রাপথে সকল তদারকি সংস্থার সক্রিয় অবস্থানের কারণে ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তি দায়ক হলেও ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার পথে তদারকি না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।’
সড়কপথে ৩৩৯ জন নিহতের বাইরে ‘একই সময়ে নৌপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত, ৫৫ জন নিখোঁজ ও নয়জন আহত হয়েছেন। রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ৩৫ জন, ট্রেনের ধাক্কায় চারজন ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে দুজনসহ মোট ৪১ জন নিহত হয়েছেন’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার হার ১৫.২৮ ভাগ’
দুর্ঘটনার যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস ও ট্রাকে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে বাসে আর ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে দুর্ঘটনার হার ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার হার। সাম্প্রতিক সময়ে সড়কে প্রাধান্য বিস্তারকারী দুই চাকার এই যানে দুর্ঘটনার হার ১৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এ ছাড়া ১২ দশমিক ২২ শতাংশ নছিমন-করিমন, ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ অটোরিকশা, ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস এবং ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ অনান্য যানবাহনের দুর্ঘটনা ছিল।
দুর্ঘটনার প্রকারের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, , ‘মোট সংগঠিত দুর্ঘটনার ৩৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩২ দশমিক ৭২ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়া, ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা, ১ দশমিক ১০ শতাংশ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে, শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ও ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুর্ঘটনার পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অন্তত আটটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে দীর্ঘ যাত্রায় চালকদের বিশ্রাম না পাওয়ার পাশাপাশি সড়কের বেহাল দশাও কথাও বলা হয়েছে। গত ২৫ জুন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দূরপাল্লার যানে বিকল্প চালক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া পরিবহনের চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, রাস্তার মাঝে চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা, সিগন্যাল দিয়ে পারাপার করা ও সিট বেল্ট পরানো নিশ্চিত করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত নিয়ম হচ্ছে, দূরের যাত্রায় একজন চালক যেন একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালান।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন। বিরতিহীন/ বিশ্রামহীন ভাবে যানবাহন চালানো। অদক্ষ চালক ও হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো। মহাসড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নছিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল। মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা। বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো। সড়ক-মহাসড়কে ফুটপাত না থাকা। সড়ক-মহাসড়কে বেহাল দশা এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল প্রধানমন্ত্রীকে সড়ক নিরাপত্তায় মনযোগ দেওয়ায় ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, যারা নেত্রীর আশেপাশে থেকে ২৪ ঘন্টা বন্দনায় ব্যস্ত থাকে তারা বা সেইসব মন্ত্রীরা নেত্রীর নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন করে আমি দেখতে চাই। তিনি সড়কে শৃংখলা ফেরাতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন প্রতিটি মানুষের জীবন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবছর ঈদে যে পরিমান মানুষ মারা যাচ্ছে তা দেশের অপুরনীয় ক্ষতি। সরকারের দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের যান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, শুধু সড়কের কারণে নয়, চাঁদাবাজির কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরী।
বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, মালিকরা শুধুমাত্র মুনাফার লোভে নিরীহ জনগণের জীবনকে নিয়ে চিনিমিনি খেলছে। ব্যবসায়িক লাভবানের পাশাপাশি সড়কে শৃংখলা ফেরাতে সরকার ও মালিক-শ্রমিক এক সাথে কাজ করতে হবে।
সেইফ রোড এন্ড ট্রান্সপোর্ট এলায়েন্স শ্রোতার সমন্বয়ক সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, সড়ক নিরাপত্তা কার্যকর করার স্বার্থে প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন আবারো জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হোক। এতে জনসাধারণ তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো আরো ভাল ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবে। এদিকে দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। প্রশিক্ষিত চালক গড়ে তোলা জন্য জাতীয় পর্যায়ে সরকারিভাবে ‘চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ গড়ে তোলা। নিয়মিত রাস্তার রোড সেফটি অডিট করা।

ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করার আহ্বানও জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এ ছাড়া ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা। মহাসড়কে ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা। মহাসড়কে নছিমন-করিমন, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বন্ধে সরকারের সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়ন করা। ভাঙাচোড়া রাস্তাঘাট মেরামত করা। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ফুটপাত, আন্ডারপাস, ওভারপাস তৈরি করে পথচারীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা করারও সুপারিশ করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।

http://www.dailysangram.com/post/335930