গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সংবাদ সম্মেলন
২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৮:১৮

৪৭ ভাগ কেন্দ্রে ১৫৯ অনিয়ম গাজীপুরে

ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষণ

সদ্যসমাপ্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশন (গাসিক) নির্বাচনে সাড়ে ৪৬ শতাংশ কেন্দ্রে কোনো-না-কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অন্যতম মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। অনিয়মের মধ্যে রয়েছে জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অননুমোদিত ব্যক্তিদের অবস্থান।
জাতীয় প্রেস কাবে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ইডব্লিউজি।
ইডব্লিউজি পরিচালক আবদুল আলীম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পর্যবেক্ষকেরা যেসব ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন সেগুলোর ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রে ১৫৯টি অনিয়ম পেয়েছেন। অনিয়মগুলোর বেশির ভাগই দুপুরের পর হয়েছে বলে তিনি জানান।

ইডব্লিউজি পরিচালক বলেন, ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ইডব্লিউজি ৫৭টি ওয়ার্ডের ১২৯টি কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত ভোটকেন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ তালিকা থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে এসব কেন্দ্র বাছাই করা হয়। পর্যবেক্ষণকৃত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১২টিতে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ৯টি কেন্দ্রে পুনরায় ভোটগ্রহণ হয়।
আবদুল আলীম বলেন, ভোট গ্রহণের শুরুতে প্রায় ৯৭ শতাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং ৮১ শতাংশ কেন্দ্রে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট দেখতে পেয়েছেন পর্যবেক্ষকেরা। পরে এজেন্টরা ছিলেন কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত গাসিক নির্বাচনের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপারে জোরপূর্বক সিল মারাসহ নানা অনিয়মের কারণে ৯টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিএনপি ভোটের ফল বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানালেও নির্বাচন কমিশন তাতে একমত নয়। ইসি বলছে, স্থগিত কেন্দ্রগুলো ছাড়া বাকিগুলোতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ইডব্লিউজির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দুপুরের দিকে চারটি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেন। ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টায় কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের অবৈধভাবে সিল মারতে দেখা গেছে। একই কেন্দ্রে বিকেল ৪টার দিকেও এভাবে সিল মারা হয়েছে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে বেলা ১১টায় পাঁচজন ভোটারকে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট পেপার দেয়া হয়নি। এ সময় বিএনপির পোলিং এজেন্টদেরও বের করে দেয়া হয়েছে। একই কেন্দ্রে বেলা ১টার দিকেও অবৈধভাবে সিল মারতে দেখা গেছে। কেন্দ্রে দায়িত্বরত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একজন মেয়র প্রার্থীর সরবরাহ করা খাবার গ্রহণ করেন। ২০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে সারা দিন কিছুসংখ্যক অননুমোদিত ব্যক্তি কেন্দ্রের ভেতর ঘোরাফেরা করেছেন। প্রিজাইডিং অফিসারের সাথেও তাদের কথা বলতে দেখা গেছে।
সংস্থাটি জানায়, তারা ৮৮টি কেন্দ্রে ভোট গণনা পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মধ্যে ২১টি কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টরা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ বা আপত্তি জানিয়েছেন। দুইটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ফলাফল শিটে একজন মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখেন। ওই সময় বিএনপির এজেন্ট উপস্থিত ছিলেন না।

ইডব্লিউজি পরিচালক আরও বলেন, খুলনা বা গাজীপুরের মতো নির্বাচন তারা প্রত্যাশা করেন না।
ইডব্লিউজির সদস্য মো: হারুন অর রশীদ বলেন, নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা কোনো অনিয়মে জড়িত হবেন না এবং কেউ করলে বাধা দেবে। কিন্তু তারা যদি অনিয়মে জড়িয়ে যায়, সেটা দুঃখজনক। সংবাদ সম্মেলনে ইডব্লিউজির সদস্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ও মো: আবদুল আওয়ালও উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পর্যবেণ করা সব ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর সময় ভোটারদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ কেন্দ্রে ১ থেকে ২০ জন ভোটার, ২০ দশমিক ২ শতাংশ কেন্দ্রে ২০ থেকে ৪০ জন ভোটার এবং ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ কেন্দ্রে ৪০ জনেরও বেশি ভোটারের লাইন পরিলতি হয়েছে। ভোটগ্রহণের সময়ে ইডব্লিউজির পর্যবেকেরা ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট এবং ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট দেখতে পেয়েছেন। ইডব্লিউজির পর্যবেণে বলা হয়, বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে (৮১ দশমিক ৪ শতাংশ) কগুলো যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে। পর্যবেণ করা ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক এবং গর্ভবতী নারী ভোটারদের ভোট প্রদানে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছিল। ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে ভোটের গোপনীয়তা রা করা হয়েছিল এবং পর্যবেণ করা ভোটকেন্দ্রগুলোতে গড়ে নয়জন নারী পোলিং অফিসারকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে গড়ে ১১ জন নারী পোলিং এজেন্টকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকেরা বেলা ৩টায় পর্যবেণ করা সব ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে কোনো অভিযোগ বা আপত্তি এসেছিল কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, ওই সময় পর্যন্ত ১৬টি অভিযোগ বা আপত্তি তাদের কাছে এসেছে।
পর্যবেণ করা কেন্দ্রে সকাল ১০টায় ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, বেলা ১টায় ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ, বিকেল ৩টায় ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বিকেল ৪টায় ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পড়ে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
এতে বলা হয়, ভোট গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইডব্লিউজির পর্যবেকেরা ৪৫ শতাংশ (৬০টি ভোটকেন্দ্র) ভোটকেন্দ্রে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম পর্যবেণ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে- জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অননুমোদিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি।

অনিয়মের কারণে পর্যবেণকৃত ১২টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়, এর মধ্যে ৯টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ পুনরায় চালু করা হয়।
ইডব্লিউজি পর্যবেণ করা ভোটকেন্দ্রে ১৫৯টি অনিয়ম লিপিবদ্ধ করেন। এগুলোর মধ্যে আছে ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি ছয়টিতে। ভোটারকে ভোটকে প্রবেশের পর আঙুলে কালির ছাপ দিয়ে বিদায় করা হয়েছে ৩টিতে। পোলিং এজেন্টকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি ৩টিতে, পোলিং এজেন্ট কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ৬টি, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা হয়েছে ২৮টি, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে প্রার্থীর যানবাহন সরবরাহ করার ঘটনা ২৪টি, কেন্দ্রে অননুমোদিত ব্যক্তির উপস্থিতি ৩০টি, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা ৮টি, ভোটকেন্দ্রের বাইরে সহিংসতা ৯টি, অবৈধভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারা ২১টি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ প্রার্থীর পে অবস্থান নেয়ার ঘটনা ৫টি, অন্যান্য ১৬টিসহ ১৫৯টি।

৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে পাঁচজন ভোটারকে ভোট প্রদানের সময় মেয়র প্রার্থীর ব্যালট প্রদান করা হয়নি। প্রায় একই সময়ে বিএনপির পোলিং এজেন্টদেরও ওই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। বেলা ১টার দিকে ওই একই কেন্দ্রে ইডব্লিউজির পর্যবেক দেখতে পানÑব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মারা হচ্ছে এবং দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একজন মেয়র প্রার্থীর সরবরাহ করা খাবার গ্রহণ করছেন।
দুপুরের দিকে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের একই কেন্দ্রে ইডব্লিউজির একজন পর্যবেককে ভোটকেন্দ্রের এক কোনায় চলে যেতে বলা হয়। পর্যবেক একটু পাশে সরে যেতেই তিনি দেখতে পান ওই কেন্দ্রের ৪টি ভোটকে উপস্থিত ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ব্যালট পেপার নিয়ে তাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলছেন।

বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ৫০নং ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে ইডব্লিউজির পর্যবেক কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ব্যালট পেপারে সিল মারতে দেখেন। বেলা ৪টার দিকে ওই একই কেন্দ্রে ইডব্লিউজির পর্যবেক আবারো অবৈধভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা প্রত্য করেন।
২০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দেখা যায়, বেশ কিছু সংখ্যক অননুমোদিত ব্যক্তি সারা দিন ধরে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছেন। বিভিন্ন সময় তাদের প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে কথা বলতেও দেখা গেছে।

ইডব্লিউজির পর্যবেণ অনুযায়ী বেশির ভাগ কেন্দ্র (৯৪ দশমিক ৮ শতাংশ) নির্ধারিত সময় বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই পর্যবেণ করা সব কেন্দ্রে ভোট গণনা শুরু হয়। পর্যবেণ করা ১২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮৮টি কেন্দ্রের গণনা পর্যবেণ করে ইডব্লিউজি। গণনার আগে সব ব্যালট বাক্সে নিরাপত্তা সিল সঠিকভাবে লাগানো ছিল। গণনার সময় ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকেরা দেখতে পান, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ফলাফল শিটে একজন মেয়র প্রার্থীর পে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখেন, ওই সময় গণনা কে বিএনপি প্রার্থীর কোনো এজেন্ট উপস্থিত ছিলেন না।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে ২৮টি সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সমন্বয়ে ইডব্লিউজি গঠিত হয়। সারা দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে সংস্থাটি।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/328731