২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ১২:২০

এক-এগারোর নতুন কুশীলব কারা?

ব্যক্তিজীবনের ঘটনা পুরনো হলে স্মৃতির অংশ হয়ে যায়। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ স্মৃতি রোমন্থন করতে চান না। জাতীয় জীবনেও ঘটে যাওয়া ঘটনা সময়ের গতিপথে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়; কিন্তু হারিয়ে যায় না।
প্রায়ই এসব ঘটনা ফিরে ফিরে আসে। জনজীবনে চিন্তার ও বিশ্লেষণের খোরাক জোগায়। বাংলাদেশে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে এক দশকের বেশি সময় আগে, ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে। এক-এগারো হিসেবে পরিচিত দিনটি প্রায়ই আলোচনায় উঠে আসে, কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথচলাকে এই দিনটি কণ্টকাকীর্ণ করে দিয়েছিল।
মইনুদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের সরকার বা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার, বিভিন্ন নামে পরিচিত এ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে আলোচিত নাম ছিল না। জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সেনাপ্রধান মইনুদ্দিনের নাম জানত না, অবশ্য সেটা জানার প্রয়োজনও তাদের পড়েনি।

অন্যদিকে যেনতেনভাবে চাকরিপ্রত্যাশী ফখরুদ্দীন আহমদকে কিছু মানুষ চিনতেন বাংলাদেশের ব্যাংকের এক সময়ের গভর্নর হিসেবে। গভর্নর পদের মেয়াদান্তে যে মানুষটি পুনরায় তার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি গ্রহণ করতে পারেন, তার আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
দু’বছরের শেষে এক-এগারোর সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা হারিয়ে যাননি। তারা দেশের জন্য এবং নিজের জন্য এমন উদাহরণ তৈরি করে গেছেন, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সময় তাদের নাম উচ্চারিত হবেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নাম আবার ফিরে আসছে।

সম্প্রতি ১৯ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন ঘিরে ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের নিয়ে বিএনপি এখন সক্রিয়, তারা ষড়যন্ত্র করছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২১ জুন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, এসব একেবারে ভিত্তিহীন, অমূলক। তিনি আরও বলেন, এসব আজেবাজে কথা নিয়ে আলোচনা করাটা তিনি মনে করেন সময় নষ্ট।
পেছন ফিরে তাকালে ওবায়দুল কাদেরের অনুভূতিটা অনুমেয়। অন্য অনেকের মতো তিনিও এক-এগারোর সময় বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। বন্দি অবস্থায় তার বক্তব্য মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এসব বক্তব্য প্রচারের অপরাধে একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক মামলার বেড়াজালে বন্দি হলেও যাদের বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে তারা তাদের বক্তব্য অস্বীকার করেছেন বলে মনে পড়ে না। আবার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য ওবায়দুল কাদের ভারতেও গেছেন। অবশ্য এসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নয়। রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত বিষয়ও সবসময় জনচক্ষুর আড়ালে থাকে না। এইচটি ইমাম বিরোধিতা করলেও আশা করি ওবায়দুল কাদের কুশীলব শব্দের মানে জেনেই তা প্রয়োগ করেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে কুশীলব হচ্ছে, নাটকের অভিনেতা অথবা নাটকের পাত্র-পাত্রী। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটানোর কুশীলব কারা হতে পারে? ওবায়দুল কাদের কি তাদের চেনেন?

এক-এগারোর ঘটনা ঘটার পর আওয়ামী লীগ এটাকে নিজেদের আন্দোলনের ফসল বলেছিল এবং ওই সরকারের বিভিন্ন হিংসাত্মক আক্রমণের পরও আওয়ামী লীগ ওই খলনায়কদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। অবশ্য না নেয়ারই কথা। কারণ ওই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। কাজেই জয়ের বিনিময়ে জয় নিশ্চিতকারীদের পুরস্কৃত তো করতে হবেই। অবশ্য এ পুরস্কার নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশের কর্তা হিসেবে নয়াদিল্লিতে পরিচিত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যে খেলা খেলেছেন তা তিনি নিজেই লিখিতভাবে তার বইয়ে স্বীকার করেছেন এবং একটি স্বাধীন দেশের প্রধান সেনাপতি নিজের চাকরি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কীভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হতে পারেন প্রণব মুখার্জি সে কথাও লিখেছেন। কাজেই এখন আর ওবায়দুল কাদের হা-হুতাশ করে কী করবেন? যদি সত্যিই সেই কুশীলবরা সক্রিয় হয়ে থাকে, তাহলে ওবায়দুল কাদেররা কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবেন? খাকি পুঁজি যখন বিভিন্নভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করে, জাতীয় অর্থনীতির অনেক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন পরিস্থিতি বদলে যায়। গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্রে পরিবর্তন আসে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে এ ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী থাইল্যান্ড এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশে এক-এগারোর উদ্যোক্তারা শুরুতে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন তারা মহাক্ষমতাধর। যে কারণে তিনটি প্রধান কাজ তারা করতে চেয়েছিলেন। সেই সুদূর মৌলভীবাজার বা যশোরে অবৈধ দোকানপাট উদ্ধার করে রাস্তা ও বাজার পরিচ্ছন্ন করতে চেয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের চরিত্র হনন করতে। একইসঙ্গে তারা প্রতিনিয়ত করেছেন অসত্যের বেসাতি। যেমন বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি নিয়ে জেনারেল মইন যে পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন তা ছিল সত্যের অপলাপ। তিনি একবারও ভেবে দেখেননি, এত টাকা পাঁচ বছরের বাজেটেও বরাদ্দ হয়নি। তাই তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলেও সেটা এখনও অমীমাংসিত। এ উদ্যোক্তারা কি শুধু অন্যের সর্বনাশ করেছেন? তা নয়। তারা যেভাবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন, সেটি কি গ্রহণযোগ্য? অনেকে বলেন, টাকার সবটাই সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। এছাড়া, তারা যে ডাল-ভাত কর্মসূচি চালু করেছিলেন তা বিডিআরের ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার একটি কারণ হিসেবেও বিবেচিত। এ উদ্যোক্তাদের বড় ব্যর্থতা ছিল তারা প্রভাবশালী অসামরিক সহযোগী বা দালাল খুঁজে পাননি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম দাঁড় করানোর জন্য। সে রকম একটি প্লাটফর্ম দাঁড় করাতে পারলে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফল হয়তো ভিন্ন হতো। এ ব্যাপারে ড. ইউনূস একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

এক-এগারোর কুশীলব আজকের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল তার জন্য কোনো দায় নেয়নি। আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী তারা প্রধানমন্ত্রীকে মেরেও ফেলতে চেয়েছিল। এ হত্যাচেষ্টা কি বিচারহীনতার সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেল?
ওবায়দুল কাদেরের কথায় আবার ফিরে যাই। সেদিনের কুশীলবদের সম্পর্কে তার দলের ভূমিকা এবং বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ দুটি এক সঙ্গে মেলে না। আর যদি তাই হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব হবে ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা। সেটা হবে না। কারণ এক-এগারোর প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরেই ঐকমত্য নেই। কারণ তখন সবাই সমানভাবে নির্যাতিত হননি। ওবায়দুল কাদেরের কথাতেই বলি, রাজনীতি হচ্ছে হিসাবের অঙ্ক।
মাহফুজ উল্লাহ : সাংবাদিক ও শিক্ষক

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/64295