২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২১

নির্বাচনী বছরে বিনামূল্যের বই নিয়ে চরম সংকট

বিনামূল্যের বই নিয়ে চরম সংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। দুই দফায় দরপত্র করেও প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বইয়ের ফয়সালা করতে পারছে না সংস্থাটি। প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দাম হাঁকানোয় প্রথম দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ দরপত্রে আগের প্রাক্কলনের প্রায় ৪৫ পয়সা দাম বাড়ানোর পরও প্রকাশকরা তার চেয়ে বেশি দামে দরপত্র জমা দিয়েছেন। এতে দ্বিতীয় টেন্ডার বাতিল হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই অবস্থা কারিগরি ও মাদরাসা পর্যায়ে বইয়ের।

প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দাম পড়ায় পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে কিছুটা স্বস্তি বিরাজ করছে মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব জটিলতায় নির্বাচনী বছরে অক্টোবরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেয়ার সরকারের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. মিয়া ইনামুল হক রতন সিদ্দিকী মানবজমিনকে বলেন, পুনঃদরপত্রের কারণে কিছু সময় বিলম্ব হয়েছে। এখন পুনঃদরপত্রে কাজ দেয়ার চেষ্টা চলছে। আশা করছি এ সংকট থাকবে না। তিনি বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে বই ছাপায় কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রাক-প্রাথমিক, কারিগরি ও মাদরাসার বই নিয়ে কিছুটা যে সংকট রয়েছে তাও দূর হয়ে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার আগে ভাগেই আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে টার্গেটে সব কিছু চলছিল। প্রাথমিক পর্যায়ের বই ছাপার দরপত্রের দাম বাড়ানোর কারণে সংকট তৈরি হয়। প্রাক্কলন ২ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু গত ১২ই এপ্রিল দরপত্র খোলার পর দেখা যায় প্রিন্টার্সরা দর হাঁকান ২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে দুই টাকা ৮২ পয়সা। এতে প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে বইয়ে সরকারের অতিরিক্ত খরচ বেড়ে যায় ১১১ কোটি টাকা। আটকে যায় প্রথম দরপত্র। সংকট কাটাতে এনসিটিবির সামনে তিনটি পথ ছিল। পিপিপি’র ৯৮ ধারার ২৫ ধারা অনুযায়ী প্রাক্কলিত বাজার দরের চেয়ে বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দর বাড়ানো, পুনঃদরপত্র আহ্বান করা এবং নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা। এনসিটিবির একটি অংশ প্রথমটির পক্ষে থাকলেও চেয়ারম্যানসহ অন্যরা সিন্ডিকেট করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করান। দ্বিতীয় দরপত্র খোলা হয় গত ২০ ও ২১শে জুন। এতে নতুন করে ৪২ দিনের বেশি সময় নষ্ট হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বিতীয় দরপত্রে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ২ টাকা ৬৯ পয়সা করে। আর প্রকাশকরা দাম হাঁকিয়েছেন ২ টাকা ৯০ পয়সার মধ্যে। পুনঃদরপত্রের কারণে সরকারের ১২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত গচ্চা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন পুনঃদরপত্র মূল্যায়ন কমিটি যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। তবে দ্বিতীয় দরপত্রে কাজ পেলেও আরো ২৮ দিনের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। তারপর প্রকাশকদের আরো ৮৪ দিন সময় পাবে। আর জরিমানা দিয়ে আরো অতিরিক্ত সময় পাবে প্রায় দুই সপ্তাহ। সব মিলিয়ে অক্টোবরের মধ্যে বই দেয়া কোনো প্রকারে সম্ভব নয় এটা স্বীকার করে নিয়েছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা। অন্যদিকে প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দাম পড়ায় কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের বইও প্রাথমিকের মত পুনঃদরপত্রে দেয়া হচ্ছে। এতে এ পর্যায়ে বই সময়মত শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, পুনঃদরপত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠান দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে কম দামে দরপত্র জমা দিয়েছে। এ কারণ হিসেবে এনসিটিবি ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, নন রেগুলার আইডেট রপ্তানির ওপর ভারত সরকার ৩০ ভাগ শুল্ক ছাড় পায় ব্যবসায়ীরা। সে হিসেবে কাগজের ওপর তারা ৩০ শতাংশ শুল্ক ছাড় পাবে। অন্যদিকে যে পরিমাণ কাগজ রপ্তানি করবে সে পরিমাণ কাগজ আমদানি করতে পারবে বলে সরকার সম্প্রতি সার্কুলার দিয়েছে। এতে তারা দু’দিক থেকেই ব্যবসা করতে পারবে। এ কারণে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কম দামে দরপত্রে অংশ নিয়েছে।
প্রকাশকরা বলছেন, প্রাথমিকের বই ৮০ গ্রাম জিএসএম ও বইয়ের কাগজের ব্লাইটনেস (উজ্জ্বলতা) হতে হয় ৮৫ গ্রাম। এ কারণে রি-সাইক্লিং পেপারে এ বই ছাপানো যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বাড়ার কারণে চলতি বছর কাগজ ও আর্ট পেপারে দু’বার দাম বেড়েছে। গত বছর এনসিটিবি ৬০ গ্রাম জিএসএমের এক টন কাগজ কিনেছিল ৬১ থেকে ৬৩ হাজার টাকায়। বর্তমানে এই কাগজের বাজার মূল্য সাড়ে ৯৫ হাজার। আর ৮০ জিএসএম কাগজের দাম এক লাখের বেশি। এনসিটিবি প্রায় ৯৬ হাজার টন করে কাগজ কিনেছে। সেখানে আমাদের গত বছর ডিসেম্বরের দর ৬৪ হাজার টন ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তারা বলেন, এনসিটিবি যেখানে ৯৬ হাজার টাকা করে কাগজ কিনেছে সেখানে আমরা ৬৪ হাজার টাকা করে কীভাবে কাগজ কিনবো।

এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির তোফায়েল খান মানবজমিনকে বলেন, পুুনঃদরপত্রে প্রাথমিকের বইয়ে যে জটিলতা আছে তা শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, মাধ্যমিক প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ২ টাকা ৭৭ পয়সা আর প্রাথমিকে ধরা হয়েছে ২ টাকা ৬৯ পয়সা। এখানে ৮ পয়সা দাম কমানো হয়েছে। মাধ্যমিকে ১০ ভাগ বাড়িয়ে কমিটি কাজ দিতে পারে। একইভাবে প্রাথমিকে ১০ ভাগ দাম বাড়িয়ে কাজ দেয়া হলে এখানে কোনো সংকট থাকবে না বলে জানান তিনি। তার মতে, ১০ ভাগ বাড়ানো হলে ৫ থেকে ৬ কোটি অতিরিক্ত লাগবে। এতে সরকারের সফল এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে। তৃতীয়বারে মতো এনসিটিবি আর কোনো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিবে না বলেও মনে করেন তিনি।
তবে এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকের পুনঃদরপত্রে প্রথম দরপত্রের চেয়ে পুনঃদরপত্রে ঠিকাদারদের অংশগ্রহণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক লটের জন্য কোনো ঠিকাদার দরপত্র জমা দেয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এবার ৯৮টি লটে প্রাথমিক স্তরের প্রায় ১১ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণ করা হচ্ছে। এর বিপরীতে প্রথমবার আহ্বান করা দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছিল মোট ৪৭৪টি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান। আর সর্বশেষ পুনঃদরপত্রে ৯৮টি লটের কাজ পেতে দরপত্রে অংশ নিয়েছে মাত্র ২৬১টি প্রতিষ্ঠান। আবার বেশ কয়েকটি লটের কাজ পেতে কোনো দরপত্র জমা হয়নি। এটাকে প্রিন্টার্সদের সিন্ডিকেট বলছেন কর্মকর্তারা। তবে প্রাথমিকে প্রতি লটের বিপরীতে প্রায় আড়াই কোটি সিকিউরিটি জমা দিতে হয়। এজন্য অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়নি বলে মনে করেন প্রিন্টার্সরা। তারা বলেন, প্রথম দফার দরপত্রে অনেকেই একাধিক লটের কাজ নেয়ার চেষ্টা করলেও দ্বিতীয় দফায় সে চেষ্টা করেনি। কারণ অনেকেই মাধ্যমিকের কাজ পেয়েছে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) বলেন, পুনঃদরপত্র খোলা হয়েছে। এখন মূল্যায়ন চলছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=123228