২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৭

সরকারি ৫ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা

এক বছরে বেড়েছে ৮৮ শতাংশ

বড় আকারের মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকারি ৫ ব্যাংক। জনগণের করের অর্থে মূলধনের জোগান দেয়ার পরেও ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না, বরং দিনদিন তা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সরকারি পাঁচ ব্যাংকের এক বছরের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে ৮৮ শতাংশ। গত বছরের মার্চ শেষে মূলধন ঘাটতি ছিল যেখানে ছয় হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা, চলতি বছরের মার্চে এসে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়াকে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বছরের পর বছর কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মেনে নেবে। দুই বছর পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে অথবা ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হলে কিভাবে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতি পূরণ করবে তার পরিকল্পনা তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তা মনিটরিং করবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতার পরিচায়ক। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। বিদেশী বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সাথে বিদেশী ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হয়। যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য রোডম্যাপ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সালে দেয়া এ রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে বলে রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়।

নির্ধারিত চার বছরের সময়সীমার মধ্যে ইতোমধ্যে সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে মূলধন সংরক্ষণ হয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ হারে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অথচ এ সময়ে তা হওয়ার কথা ছিল ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ জন্য প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এ কারণেই আন্তর্র্জাতিক মানদণ্ডে দেশের ব্যাংকিং খাত পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংকিং খাতে ভুয়া ঋণ বেড়ে গেছে। শত শত কোটি টাকার জামানতবিহীন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকি ভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে। এ সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অপর দিকে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে বেড়ে গেছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অর্থই হলো ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারায় সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ছয় হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল দুই হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৭০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬৩৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৭৮ কোটি টাকা। তবে অগ্রণী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আগের বছরের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে। যেমন বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দুই হাজার ৯৬২ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে এক হাজার ৯২৬ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের ৪৪২ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৩৩৬ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এ কারণে মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। ফলে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে।
এ কারণে থার্ডপার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে। পরিস্থিতি উন্নতি করতে হলে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্কতার সাথে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/328373