২৭ জুন ২০১৮, বুধবার, ১১:০১

চালে বাজেটের উত্তাপ

০ পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, তবুও সক্রিয় সিন্ডিকেট ০ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা কমতে পারে

০ দাম বাড়ার যৌক্তিক কারণ নেই
প্রস্তাবিত বাজেটে (২০১৮-১৯ অর্থবছর) চাল আমদানিতে নতুন করে শুল্ক আরোপের পর সক্রিয় সিন্ডেকেটের কারসাজিতে ফের উত্তাপ ছড়াচ্ছে চাল ও ধানের বাজারে। চলতি মাসের ৭ জুন বাজেট ঘোষণার পর সব ধরনের মোটা চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত মোটা চালের মজুদ বাড়াতে শুরু করেছেন। বেড়ে গেছে ধানের দাম। এই বাস্তবতায়, চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা কিছুটা কমিয়ে আনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে পূর্বের মতো ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের ঘোষণার পরপরই সরবরাহ পর্যায়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটচক্র পরিকল্পিতভাবে সরবরাহ চেইনে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি দাম নিচ্ছেন। খুচরা পর্যায়ে স্বর্ণা ও ইরি জাতের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪-৪৫ টাকায়। শুধু তাই নয়, ভালমানের মোটা চাল কোন কোন দোকানদার প্রতি কেজির দাম রাখছেন ৫০ টাকা পর্যন্ত। ঈদের ছুটি শেষে অনেকে চাল কিনতে গিয়ে বাড়তি দাম দিচ্ছেন।

চাল ব্যবসায়ীদের মতে, আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা পুনর্বহাল না হলে মোটাসহ সরু চালের দামও বাড়বে। ২৮ শতাংশ শুল্কারোপের ফলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয় রাখতে ব্যবসায়ীরা সারাবছর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে নিয়মিত চাল আমদানি করে থাকেন। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা চালের দাম বৃদ্ধির হুজুগে দেশে উৎপাদিত চালের দামও বাড়ছে প্রায় একই হারে। এর প্রভাব পড়েছে সারাদেশে চালের পাইকারি বাজারে। খুচরা বাজারে দামের উত্তাপ আরও বেশি।
গত ৭ জুন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় চাল আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। ওই সময় তিনি বলেন, কৃষকের উৎপাদিত ধান চালের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে সর্বোচ্চ আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ পুনঃআরোপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গম, ভুট্টা, আলু ও কাসাভা থেকে উৎপাদিত স্টার্চের শুল্ককর যৌক্তিকীকরণ করে আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ১০ শতাংশ হারে নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

মূলত অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই চালের বাজারে অস্বস্তি বিরাজ করছে। প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর একটু একটু করে চালের দাম বাড়ছে। তবে ঈদের ছুটির পর ঢাকা ফিরে যারা চাল কিনতে বাজারে যাচ্ছেন, তাদের বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। খাদ্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, সরকারি গুদামে খাদ্যশষ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় সরকার এবার আমদানি না করে দেশের ভেতর থেকেই চাল সংগ্রহ করবে। আরও ৫-৬ মাস চালের কোনো সমস্যা হবে না, আমদানিরও দরকার হবে না। তবে আমদানি শুল্ক বাড়ায় বাসমতি ও ভালো মানের চিকন চালের দাম বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৩ লাখ ২৩ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার টন গম। এছাড়া খালাসের অপেক্ষায় বন্দরে আছে ৫২ হাজার টন খাদ্যশস্য। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ জুলাই থেকে গত ১১ জুন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে ৮৩ লাখ ২০ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ২৯ লাখ ৪৪ হাজার টন চাল এবং ৫৩ লাখ ৭৬ হাজার টন গম। এই সময়ে সরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৯২ হাজার টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে ১১ লাখ ১৬ হাজার টন চাল এবং ৪ লাখ ৭৬ হাজার টন গম।

গত বছর এপ্রিলের শুরুতে আগাম বৃষ্টি ও বন্যার কারণে ফসলহানি ও মজুদ তলানিতে নেমে আসায় চাল আমদানিতে শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে দুই শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, সরকার চায় কৃষক ধানের দাম পাক, কৃষক দাম পেলে চালের দাম তো বেশি হতেই পারে। নতুন করে শুল্ক আরোপের পর আর চাল আমদানি হচ্ছে না জানিয়ে লায়েক আলী বলেন, এই সময়ে ধানের দাম মণপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। নির্বাচন নিয়ে সরকার সচেতন আছে, কৃষক না ভোক্তাদের সুবিধা দিয়ে তাদের লাভ হবে তা তারা ভালো বোঝেন। এ নিয়ে আমরা কিছু বলতে চাই না। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে চাল বিক্রি করি।

গতকাল ঢাকার বাদামতলী বাজারে নাজিরশাইলের বস্তা ২৭৫০-২৯০০ টাকা, মিনিকেট ২৬০০-২৭৫০ টাকা, বি আর-২৮ চাল ২১০০-২১৫০ টাকা এবং বি আর-২৯ হাসকি (অর্ধসিদ্ধ বি আর-২৮ চাল) ২০০০-২১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজারে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা নাজিরশাইল ২৮০০-৩০০০ টাকা, মিনিকেট ২৭০০-২৮০০ টাকা এবং বি আর-২৮ চাল ২১০০-২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, উন্নতমানের নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল ৬০-৬৬ টাকা, পাইজাম ও লতা ৪৮-৫৪ টাকা এবং স্বর্ণা ও চায়না ইরি ৩৮-৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। কাপ্তান বাজারের নুরু রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী নুরু মিয়া বলেন, বাদামতলীর পাইকারি বাজারে চালের দাম বেশি। আর এ কারণে খুচরা বাজারেও চালের দাম বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি বাড়ছে আমদানিকৃত চালের দাম। বাজেটে সরকার নতুন করে কর বাড়ানোর ফলে চালের দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি। কারওয়ান বাজারের চালের দোকান ফিরোজ অ্যান্ড সন্সের মালিক ইসমাইল হোসেন খোকন বলেন, জুন মাসে চালের দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি। চালের দাম বাড়বে কি না, কতটা বাড়বে তা আগামী সপ্তাহে হয়ত বোঝা যাবে।

এদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর সব কটি ধানের মৌসুমে দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে ৬৫ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। এছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সরকারের খাদ্য গুদামে এখন ১০ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ আছে। স্থানীয় বাজার থেকে আরও কেনা হচ্ছে নয় লাখ টন চাল ও এক লাখ টন ধান। অন্যদিকে গত এক বছরে সব মিলিয়ে ৮০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ লাখ টন দেশে বাজারজাত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সময়ে আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪৬ দশমিক ৪৩ লাখ টনের। এসব চাল শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং ব্যাংক ঋণের সুবিধা নিয়ে আমদানি করা হয়েছে। এই অবস্থায় চালের দাম বাড়ার কোন যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চাল আমদানির এলসিতে কড়াকড়ি
দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক ও চাল উৎপাদকরা যেন ধানের ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিতে চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলায় শর্ত জুড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, চাল আমদানির ক্ষেত্রে ঋণ ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মার্জিনের হার নির্ধারণ করে ঋণপত্র খোলতে হবে। তবে কোনো অবস্থায় শূন্য মার্জিনে চালের ঋণপত্র যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছে ব্যাংকগুলোর এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এতদিন চাল আমদানিতে শূন্য মার্জিনে ঋণপত্র খোলার সুযোগ ছিল।

বিআরপিডি সার্কুলারে বলা হয়েছে, সা¤প্রতিক সময়ে দেশের আবহাওয়া ধান চাষের অনুকূলে থাকায় চলতি বছর ধানের উৎপাদন সন্তোষজনক হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কৃষক ও স্থানীয় চাল উৎপাদকদের ধান/চালের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করাসহ কৃষকদের ধান চাষে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। চাল আমদানির ক্ষেত্রে ঋণ ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মার্জিনের হার নির্ধারণ করে ঋণপত্র খোলার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হলো।

 

 

https://www.dailyinqilab.com/article/138373