২৭ জুন ২০১৮, বুধবার, ১০:৪৯

প্রিজাইডিং অফিসারদের রহস্যজনক আচরণ

তখন সকাল ১০টা বেজে ১ মিনিট। টঙ্গীর মন্নু টেক্সটাইলস মিলস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে লোকজনের বড় ধরনের জটলা। এগিয়ে যেতেই দেখা গেল ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। কেউ কেউ ভোট না দিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন। তবে সেখানে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কেন্দ্রের ভেতরে যাওয়ার জন্য স্কুলের পকেট গেট খোলা আছে। ওই একটি গেট দিয়েই ভোটাররা আসা-যাওয়া করছেন। গেটের সামনে যেতেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর এক সদস্য প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, আপনি কে?। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল স্কুলের মাঠ ফাঁকা। দুয়েকজন ভোটার আসা-যাওয়া করছেন। স্কুলের প্রথম তলা ও দ্বিতীয় তলাসহ পাশের টিনশেডের ৯টি কক্ষে একযোগে ভোট গ্রহণ চলছে। নিচতলায় ছোট লাইন থাকলেও দ্বিতীয় তলায় ভোটারদের তেমন আনাগোনা নেই। ১ নম্বর বুথ কক্ষ পরিদর্শন করতে গেলে ঘটে বিপত্তি। দায়িত্বরত আনসার সদস্য মজনু বললেন, সাংবাদিকদের বুথ কক্ষে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। কেন নিষেধ আছে জানতে চাইলে বলেন, জানি না, স্যারের অর্ডার। তখন দায়িত্বরত এসআই সোহাগ নিচ থেকে একপ্রকার দৌড়ে এসে বললেন, ভাই, বোঝেন-ই তো। ওপরের নির্দেশ আছে। সাংবাদিকদের বুথ কক্ষের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে পরিদর্শন করে যান। এভাবে দ্বিতীয় তলার বুথ কক্ষে সাংবাদিকদের জন্য অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে নিচতলায় কিছুটা শিথিল ছিল।

ওই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা তিন হাজার ৪৪৮ জন। প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন আনন্দ কুমার দাস। নিচতলার এক কক্ষে বসে কী যেন করছেন। পরিচয় দিয়ে তার কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ওপরের নির্দেশ আছে, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা যাবে না। ‘বাইরে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন, ভেতরে ফাঁকা কেন’ অনেক জোরাজুরির পর তিনি বলেন, গেট থেকে না পাঠালে আমি কী করব? উপস্থিত কয়েকজনের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ওই কেন্দ্রের দ্বিতীয়তলার কক্ষগুলোতে ধানের শীষের এজেন্ট ছিল না।

এভাবে সিরাজউদ্দিন সরকারি বিদ্যা নিকেতন অ্যান্ড কলেজ, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, ৫৬ নম্বর মজুখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, হাজী পিয়ার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরেও সাংবাদিক প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি দেখা গেছে। ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে; কিন্তু বুথ কক্ষ পরিদর্শন ও ছবি না তোলার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ও দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসাররা বেশ কঠোর অবস্থানে ছিল। কেন্দ্রের বাইরে দীর্ঘ লাইন থাকলেও ভেতরে ভোটারদের ঢুকতে না দেয়ারও নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঁচটি কেন্দ্র করা হয়েছে, যার ভোটার সংখ্যা ১৪ হাজার। ৩১২ নম্বর কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আবু শাহাদাৎ মো: জাবের। বেলা ১টা বেজে ৪৫ মিনিটে গিয়ে দেখা যায় তিনি স্কুলের দ্বিতীয়তলায় তার নির্ধারিত কক্ষে গেটে তালা দিয়ে অবস্থান করছেন। প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে যেতে অনন্ত তিন দফায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর এক সদস্য তাকে অবহিত করার পর আগে পরিচয়পত্র দেখে পরে গেটের তালা খুলে সাক্ষাৎ করার সুযোগ মেলে। এ বিষয়ে তার কাছে প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণ হচ্ছে। তখন পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে দুই হাজার ৭৬৯ ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ৯৫০টি।

টঙ্গীর আরেকটি ভোট কেন্দ্র শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র। এটি মহিলা ভোট কেন্দ্র। বেলা ১১টা পর্যন্ত দুই হাজার ১৬টি ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে তখন মাত্র ২৩৫টি। ওই কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন গাউস-উল হাসান মারুফ। আঁকাবাঁকা সরু গলি পার হয়ে তার কক্ষে যেতে হয়। ওই সরু গলিতে আবার মহিলা ভোটাররা ভোট দেয়ার জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। সেটাও একটা বেশ রহস্য বটে।

বেলা ১টায় যখন ৫৬ নম্বর মজুখান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুর রহিম মির্জার সাথে আলাপ হচ্ছিল তখন ঘুড়ি প্রার্থীর এজেন্ট অ্যাডভোকেট ওসমান খান এসে অভিযোগ করলেন, স্যার, জোর করে একজন আরেকজনের সিল মেরে দিচ্ছে। এ বিষয়ে ওই প্রিজাইডিং অফিসার বলেন, সকাল থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি। এই মাত্র একটি অভিযোগ পেলাম। ওই ভোট কেন্দ্রের অনেক বুথে ধানের শীষের এজেন্ট ছিল না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রিজাইডিং অফিসার এ প্রতিবেদককে বলেন, কী বলব, রাত থেকে হুমকি-ধমকির মধ্যে আছি। সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আত্মীয়স্বজন দিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। তারা যা বলবে তাই করতে হবে। অন্যথায় কিভাবে ভোট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যায় তারা দেখে নেবে। এরপরে আর কী বলার থাকে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/328223