২৭ জুন ২০১৮, বুধবার, ১০:৪০

নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে

অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান : নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, নদী মরলে দেশ মরবে। বিপন্ন পরিবেশ-বাঁচাও প্রাণ বাঁচাও দেশ “নদীর একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে এই তো নদীর খেলা-সকাল বেলায় আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা”। পৃথিবীতে প্রাণী জগৎ বেঁচে থাকার জন্য ধমনীতে যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি দেশকে বাঁচতে হলে সে দেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি।
ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত দেশের মধ্যে ২য় স্থানে। ১ম স্থানে রয়েছে হন্ডুরাস এবং ৩য় থেকে ১০ম স্থানে রয়েছে সোমালিয়া, ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া, ভিয়েতনাম, ডেমিনিকান, প্রজাতন্ত্র ফ্রান্স, ভারত, চীন।
বিশ্বের সব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদী মাতৃকতা দিয়ে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এক্ষেত্রে কালের বিবর্তণে সে স্মৃতি আজ মৃত প্রায়। দেশের নদী সংখ্যা এখন মাত্র ২৩০ হলেও খোদ রাজশাহীর পদ্মার পানি থাকে তিন মাস। যমুনার পানিও থাকে ৩ থেকে ৪ মাস। ফলে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল এর নদীগুলোতে ৯ মাসই পানি না থাকায় বেশিরভাগ চরাঞ্চলে জেগে থাকে ধুধু বালুচর।
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। পানি প্রবাহ আছে বলেই এদেশ এত সুজলা-সুফলা সবুজ বন বনানীর সমারোহ। নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- আর দখল রাজত্ব নদীকে অঙ্গহানী করায় তিলে তিলে নদীগুলো একের পর এক মরে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে। সেচ চাহিদা মিটচ্ছে মাটির নিচের পানি দিয়ে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হু হু করে নিচে নেমে যাচ্ছে এবং মাটির গুনাগুন নষ্ট হয়ে পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটছে। নদী রুটে সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে জন পরিবহন, মালামাল পরিবহন মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। নদীর মৎস্য সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সৃষ্ট প্রভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিগত ৮০ বছরে সোনার বাংলায় নদী সিকস্তি চরবাসীদের জীবন সংগ্রামের নানা রকমারিতা রয়েছে। উপর্যপরি ভয়াবহ বন্যার কারণে নাব্যতা কমে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার বালুকারাশিতে ধুধু বালুচর পড়ায় খরা সৃষ্টি হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত উত্তাপে লাখ লাখ একর ফসলি জমি আবাদ যোগ্যতা হারিয়েছে।
ভৌগলিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রাকৃতিক দূযোগ কবলিত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় সহায় সম্বল হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ লাখ চরের মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের আইপিসিসি প্রতিবেদনে জানা যায় ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরবে। পিআইডি’র ফিচারের তথ্যমতে জানা যায় গত ৫০ বছরে সংঘঠিত ৯টি বড় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬১ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। উপকূলীয় ৮ হাজার ৯’শ বর্গকিলোমিটার এলাকার জনগণ অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে। ২০১৭ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলের ৭টি জেলার অন্তত ১৫’শ বর্গকিলোমিটার বালুচর পরেছে। যে কারণে কুড়িগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জ জেলা পর্যন্ত যমুনা নদীতে দেড় শতাধিক নৌ-ঘাটের পরিত্যক্ততা লক্ষ করা যায়। নদী উপকূলীয় ১৪ জেলার সাথে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরের সাথে নৌপথে যাতায়াত ও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশে^ বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেক্স রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ।

নাব্যতা হারানোর ফলে যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদী উপকূলীয় এলাকায় ৪০ বছরে নদী ভাঙ্গনে বিলিন হয়ে গেছে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর ফসলি জমি। বাস্তুহারা হয়েছেন ৪০ লাখ মানুষ। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ফলে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পরেছে নদী উপকূলীয় ১৯ জেলার বাসিন্দাদের উপর।
দখল, ভরাট, দূষণ আর নাব্যহীনতায় দেশের ছোট ছোট নদীগুলোর পাশা-পাশি বড় বড় নদীগুলো আজ অস্তিত্বের মুখো-মুখি। অর্থনীতির প্রাণ কর্ণফুলি বিপন্ন। দূষণ ও ভাঙ্গণে জর্জড়িত কুশিয়ারা। দখল-দূষণ আর ভাঙ্গণের শিকার কীর্তণখোলা। পরিকল্পনা আর প্রকল্প ব্যবস্থাপনার অভাবে করতোয়া মৃতপ্রায়। ভরাট আর অস্তিত্ব সংকটে ব্রহ্মপুত্র। উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে তিস্তা ও গজলডোবা নদীতে পক্ষাঘাত।

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সৃষ্ট প্রভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বিগত ৮০ বছরে বাংলাদেশে নদী সিকস্তি চরবাসীদের জীবনে নেমে এসেছে এক মহা দূর্যোগ। উপর্যপরি বন্যা, নাব্যতাহীনতায় খরা আর বিস্তীর্ণ এলাকা ধুধু বালুরাশিতে মাত্রাতিরিক্ত উত্তাপে লাখ লাখ একর ফসলী জমি অনাবাদি হয়ে পরেছে। কথায় আছে ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। একথাটি যেমন সঠিক ও তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে এটিও গুরুত্বপূর্ণ।

হিমালয় অঞ্চলে ভারত, নেপাল, ভূটান ও চীন ৫৫৩টি বাঁধ দিচ্ছে। ভারতের ফারক্কা বাঁধের পর বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর বন্যা হয় ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ২০০৪ ও ২০১৭ সালে। ফলে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ছাড়াও ভুমি, কৃষি, জীব বৈচিত্র, পরিবেশ নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, যাতায়াত ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের আইপিসিসি প্রতিবেদনে জানাযায়-২০২০ সালে মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণাঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। সুপেয় পানি পাওয়া যাবে না এবং জমি অনুর্বর হবে। বাংলাদেশের ভাঙ্গন প্রবণ নদীর মধ্যে যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ব্র‏হ্মপুত্র ও তিস্তা অন্যতম। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বিগত ৪০ বছরে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর ফসলী জমি, বস্তুহাড়া হয়েছে ৪০ লাখ মানুষ, ক্ষতির পরিমান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাক্ষুসে যমুনা, পদ্মা, তিস্তা ও ব্র‏হ্মপুত্র নদ-নদীসহ উপনদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে অন্তত ১৯ জেলার নদী উপকুলীয় বাসিন্দা।

গতবারের বর্ষার পর দেশের উত্তরাঞ্চলের ৭ টি জেলার অন্তত ১৫শ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বালু চর পড়েছে। ফলে রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশের সাথে নেী যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ১৯৯০ সালের পর যমুনা নদীর নাব্য সংকটের কারণে ফেরি সার্ভিস গুলো বন্ধ হওয়ায় অল্প সময়ে সল্প ব্যয়ে যাত্রী পারাপার, কৃষি পণ্য সামগ্রি, ডিজেল, সার সরবরাহ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহন করা মারাত্বক ভাবে ব্যহত হচ্ছে। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলা পর্যন্ত যমুনা নদীতে নৌকা ঘাট ছিল প্রায় দেড় শতাধিক। পানির সল্পতাহেতু চর ও ডুবো চর পড়ায় নৌকা চলাচল করতে না পারায় ঘাটগুলোর বেশীর ভাগই বর্তমানে বন্ধ হয়ে পড়ছে।
ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পদ্মার, গজলডোবা বাঁধ দিয়ে যমুনার, চিঁপাইমুখ বাঁধ দিয়ে মেঘনার পানি প্রবাহ বন্ধের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে ভারত। অথচ এ তিনটি নদী বাংলাদেশের প্রাণ। ভারতের বাঁধ ও পানি আগ্রাসনের ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত মরুকরণ হয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। পদ্মা নদীতে হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে ১৫টি পিলারের মধ্যে ১২টি দাঁড়িয়ে আছে শুকনো বালুর চরে। যমুনা ব্রীজের অবস্থা বর্তমানে অনেকটা এরকমই।

নদী একদিকে যেমন আশির্বাদ, অন্যদিকে অভিষাপ ও দুঃখ বেদনার উৎস। নদীর পানিতে পলিমাটি ভেসে এসে বিস্তীর্ণ এলাকার জমি উর্বর করে। সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলে ভরে উঠে বিস্তর প্রান্তর। তেমনি নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার বর্ষা মৌসুমে নদীর দু’কুল ছেয়ে পানি উপচে পড়ায় তলিয়ে যায় মাঠ-ঘাট পথ-প্রান্তর জনপদ।
গত ২৫ জানুয়ারী “কম্প্রিসেনসিভ প্লান ফর স্টাবিলাইজেশন অব দ্য যমুনা রিভার এ্যান্ড পাইলট ইন্টারভেনশন ফর ল্যান্ড বিফেলী সেশন” এর উপর এক মডেল উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীকে দেশের জীবন প্রবাহ হিসেবে অভিহিত করে দেশবাসীকে নতুন উপলদ্ধির এক সোনালী বার্তা জানিয়েছেন। তিনি সুষ্ঠ নদী ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন- দেশ রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য নদী বাঁচাতে হবে। তিনি নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি, নদী থেকে ভূমি পূনরুদ্ধারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন- নদী প্রবাহ আমাদের জীবন প্রবাহ। এক্ষেত্রে সুষ্ঠ নদী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অধিক।

জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে রাজধানীর ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে এক সম্মেলনে “পরিবেশ ও জলবায়ু” শীর্ষক দক্ষিণ এশিয়া জুডিশিয়ান কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এক ভাষনে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ আহবান জানান। তিনি বলেন- যে সব দেশ প্রথম প্যারিসচুক্তি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল গঠনকারী প্রথম দেশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে, গত ২৫ জানুয়ারী ২০১৭ খ্রিঃ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত “নৌপথে নাব্য বাড়ানো ২২ লাখ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা” শিরোনামে জানা যায় সারা দেশে নদ-নদী খাল, পুকুর খননের মাষ্টারপ্লান চুড়ান্ত করতে যাচ্ছে সরকার। পদ্মা ও মেঘনা সহ মোট ৪০৫ টি নদী ৬ হাজার ৫৩৬টি খাল, ১৮ হাজার ৪০৩টি পুকুর খনন করা হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ঐ প্রতিবেদনে। এতে ধরা হয়েছে ২২ লাখ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ৭ গুন। আগামী ১৫ বছরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় ও স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এ মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে নদী গুলোর ২৪ হাজার কিলোমিটার নাব্যতা বাড়বে। ফলে নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন গতিশীল হবে। মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং সুপেয় পানির চাহিদা মিটবে। সমুদ্র মানচিত্রের আকার কলেবরে বৃদ্ধির অসাধারণ সফলতা অর্জনকারী বাংলাদেশকে এবার নদীর নাব্যতা পাল্টানোর সফলতা অর্জনের মহাকর্মযজ্ঞে অংশগ্রহন করতে হবে। জাতি আজ সে আশাতেই প্রহর গুনছে।

 

http://www.dailysangram.com/post/335590