২৬ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৪০

খুলনার চেয়েও গাজীপুরে খারাপ নির্বাচনের আশঙ্কা

# সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় পুলিশ - বিএনপি
# এসপি প্রত্যাহারের দাবি জানালেই মানতে হবে এমন কথা নেই - আ’লীগ
# পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার না করতে হাইকোর্ট ও ইসির নির্দেশ
# খুলনার মেয়র প্রচারণায় ছিলেন
মিয়া হোসেন: আজ মঙ্গলবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন নিয়ে কারচুপি ও ভোট ডাকাতির শঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের কারচুপির নির্বাচনের চেয়েও খারাপ নির্বাচন গাজীপুরে অনুষ্ঠিত হবে বলেও আশংকা তাদের। নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি অভিযোগে গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে বার বার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি পুলিশ সুপার প্রত্যাহারের দাবি জানালেই তা মানতে হবে এমন কথা নেই। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার বা হয়রানি না করতে হাইকোর্ট ও নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারণার চিত্র উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে পুলিশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রচারণার ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছে। এমন কী পুলিশের গাড়ীতে চড়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি করার অভিযোগ বার বার করে আসছে বিএনপি। এ অভিযোগে তারা গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে সরকার দলীয় লোক উল্লেখ করে তাকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেয়নি।

এদিকে গাজীপুরে ভোটের তিন দিন আগে বহিরাগতদের অবস্থানে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সেখানে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার প্রচার চালানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে প্রচারে যাওয়া আওয়ামী লীগের এক নেতা জানিয়েছেন, তিনি এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানতেন না। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমও একই কথা বলেছেন।
নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি অনুযায়ী শনিবার মধ্যরাত থেকেই গাজীপুরে বহিরাগতদের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে রোববার সকালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতা গাজীপুর যান্। খুলনার নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনের স্থগিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলামও প্রচার চালান সেখানে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় এবং অপু উকিল পুবাইল এলাকায় প্রচার চালান।
গত রোববার দুপুরে গাজীপুরের ছয়দানা এলাকায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন নওফেল। তবে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের মুখে সংবাদ সম্মেলন শেষ না করেই মঞ্চ ত্যাগ করেন তিনি।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রোববার রাতে গাজীপুরে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, এ অভিযোগ করে রিজভী বলেন, ‘রোববার রাতে শত শত বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতার করা হয়েছে এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে।’ অবিলম্বে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ইসিতে আওয়ামী লীগ
বিএনপি গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুণ অর রশিদকে প্রত্যাহারের দাবি জানালেই সেই দাবি মেনে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। গাজীপুর নির্বাচনে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হবে না বলেও মনে করেন তিনি।
গতকাল সোমবার দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল আজ সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে।
গাজীপুরের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট বলে জানান এইচ টি ইমাম। তিনি বলেন, নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে আমরা যেমন সন্তুষ্ট, নির্বাচন কমিশনও সন্তুষ্ট। তাঁরা নিজেরাই বলেছেন, সেখানে অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ দেখছেন কমিশন।
নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবেন উল্লেখ করে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করছে।’
পুলিশ সুপার প্রসঙ্গে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘বিএনপি এসপি হারুনকে প্রত্যাহার করতে বললেই করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। হারুনের বিষয়ে নির্দিষ্ট করে প্রমাণ থাকতে হবে তো। কেন খারাপ, সেটাও বলতে হবে। প্রমাণ ছাড়া এসব বললে তো হবে না।
বিএনপি বিভিন্ন ধরনের কথা বলে আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিইসি নিজেই ডিআইজি ও পুলিশ সুপারকে এমন কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে সবাই ভয়ে আছেন। এবং আমি মনে করি না, এখানে কোনো ধরনের ঝামেলা হওয়ার সুযোগ আছে।’

গাজীপুরের আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে দেখা গেছে পুলিশের গাড়িতে চড়ে তিনি নির্বাচনী এলাকায় প্রচার চালাচ্ছিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা। তিনি এতটা কা-জ্ঞানহীন হবেন যে পুলিশের গাড়িতে চড়বেন? তাঁর কি গাড়ির অভাব আছে নাকি?’
এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশ না করার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান আওয়ামী লীগের এই উপদেষ্টা।
এইচ টি ইমাম বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) একটু দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করুন। আপনারা সব সময় যদি নেগেটিভ নিউজ করতেই থাকেন, তাহলে জাতি বিভ্রান্ত হবে। অনেকেই বিভ্রান্ত হবেন। তা না করে যেটি ভালো সেটি করুন।’
আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবীর কাউসার, ঢাকা বিভাগের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক সচিব রাশেদুল ইক এবং আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া।

পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার নির্দেশ
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীর নির্বাচনী নেতাকর্মী, সমর্থক ও এজেন্টদের যেন গ্রেফতার করা না হয় তা নিশ্চিত করতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী, তার সমর্থক এবং প্রচারকারীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের গাইডলাইন মেনে চলতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে।
দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, নির্বাচন কমিশন, পুলিশের মহাপরিদর্শক, গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারসহ ৮ জনকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মাদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ নির্দেশনা দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, একেএম এহসানুর রহমান, সানজিদ সিদ্দিকী প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সোমবার গাজীপুরে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধের নির্দেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার রিটটি করেন।

রিটে গ্রেফতার সংক্রান্ত আপিল বিভাগের নির্দেশনা ভঙ্গ করে গাজীপুরে গ্রেফতার বা হয়রানি না করার নির্দেশনা ও রুল জারির নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল।
গাজীপুরে বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক, ভোটের প্রচারণাকারীদের গণগ্রেফতার, হয়রানি করা কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বর্হিভূত ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
রিট আবেদনে বলা হয়, গাজীপুরে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনি প্রচারণার সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেটা আইনসম্মত নয় এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিপন্থী। সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য করে এটা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আইন মানছেন না।
এর আগে গত রোববার নির্বাচন কমিশন থেকেও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার বা হয়রানি না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
২৪ জুন নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে গাজীপুরের পুলিশ সুপারকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে এসে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সকল দল এবং প্রার্থীদের সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণ, পুলিশ বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার-হয়রানিসহ কতিপয় অভিযোগ উত্থাপন করেন। সেগুলোর প্রতিকারের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশন বরাবর একটি আবেদন করেছেন।
উল্লেখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার না করার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। এ অবস্থায় নির্বাচন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কোনো বাসিন্দা বা কোনো ভোটারকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার না করার জন্য নিদের্শ প্রদান করা হয়।
গাজীপুর সিটিতে ৫৭টি সাধারণ এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড রয়েছে। এ সিটি কর্পোরেশনের মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৭ জন। এরমধ্যে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩৫ জন পুরুষ এবং ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন নারী ভোটার। নির্বাচনে সাতজন মেয়র, ৮৪ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

http://www.dailysangram.com/post/335416