২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:১৯

বিষাক্ত বর্জ্যে নীল হালদা

মাছের মড়ক : বিপন্ন এলাকা ঘোষণার দাবি

বিষাক্ত বর্জ্যে বিপন্ন হতে চলেছে বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী।
মঙ্গলবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ৫ দিনে হালদা ও এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন খালে মরে ভেসে ওঠে শত শত মরা মাছ। রোববার থেকে আর মরা মাছ পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীটি এখনও বিপদমুক্ত নয়। এখনও অব্যাহত আছে দূষণ। বিষাক্ত বর্জ্য পড়া বন্ধ করা না গেলে মাছ ও সুপেয় পানির উৎস এই নদী অদূর ভবিষ্যতে বুড়িগঙ্গার দশায় পড়বে।
বর্জ্যরে কারণে অক্সিজেন কমে যাওয়া ও এমোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় হালদার হাটহাজারী ও রাউজান অংশের ৭-৮ কিলোমিটার জুড়ে মাছ মরে যাচ্ছে। তবে হাটহাজারী অংশেই ক্ষতি বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা জানান, গত ১২ থেকে ১৬ জুন টানা বর্ষণে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এই তিন উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে হালদা নদী। বন্যার পানি বিভিন্ন খাল হয়ে নামার সময় শিল্পকারখানা এবং দীর্ঘদিন জমে থাকা বর্জ্য নিয়ে যায় হালদা নদীতে। আর এসব বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়ে হালদা ও সংলগ্ন কয়েকটি খালের পানি। দূষণের কারণে প্রায় ২০ প্রকারের মাছ মারা গেছে যার মধ্যে রয়েছে চিংড়ি, কুঁচিয়া, বাইম, আইড়, রুই, কাতল, মৃগেল। এ ছাড়া টেংরা, পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রকারের ছোট আকারের মাছও মারা গেছে ব্যাপক হারে। বিভিন্ন স্থানে পচা মাছ থেকে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ।
হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, হালদা ও সংযুক্ত খালগুলোয় মাছের মড়ক লাগার বিষয়টি মঙ্গলবার আমাদের নজরে আসে। মঙ্গল ও বুধ এই দু’দিনে সবচেয়ে বেশি মাছ মারা গেছে। এর পরের কয়েকদিনেও মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখা গেছে। তবে রবি ও সোমবার নতুন করে মাছ মারা যাওয়ার খবর আমরা পাইনি।
তিনি জানান, হাটহাজারীর উত্তর ও দক্ষিণ মাদার্শা এলাকার পুরালিয়া খাল, মাদারী খাল, কাটাখালী খাল, খন্দকিয়া খাল এবং বিস্তীর্ণ শ্রী বিল ও নিচের দিকে হালদা নদীতে মরা মাছ ভেসে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে আমরা পানি দূষণের চারটি কারণ চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য, নদীর তীরের কয়েকটি পোলট্রি ফার্মের বর্জ্য এবং বিভিন্ন বাজারের বর্জ্য সরাসরি নদীতে মিশে যাওয়া। এ ছাড়া কর্ণফুলী দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে নন্দীরহাট এলাকায় স্থাপিত এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য। এই কারখানাটিতে এটিপি থাকলেও তা সব সময় চালু রাখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এর বর্জ্য বিভিন্ন খাল হয়ে চলে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে।
এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথমদিকে যখন বেশি হারে মাছ মারা যাওয়া শুরু করে তখন শ্রী বিল, মাদারী খাল, কাটাখালী খাল ও খন্দকিয়া খালের বিভিন্ন পয়েন্টে পানির নমুনা পরীক্ষায় অক্সিজেনের মাত্রা পাওয়া গেছে ১ দশমিক ২ মিলিগ্রাম পার লিটার যা সর্বনিু ৫ থাকার কথা। এ ছাড়া ওইসব স্থানে এমোনিয়ার মাত্রা পাওয়া যায় ১ দশমিক ৫ পিপিএম। এমোনিয়ার সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ১ পিপিএম। বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে এমোনিয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে রোববার থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। এদিন নমুনা পরীক্ষায় কোথাও কোথাও অক্সিজেনের মাত্রা ৫-এর উপরে পাওয়া গেছে।’
গত কয়েকদিনে হালদায় কী পরিমাণ মাছ মারা গেছে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি বলেন, ‘ হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ৭-৮ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন স্থানে প্রচুর মাছ মারা গেছে। এর মধ্যে কিছু ভেসে উঠেছে। কিছু পানির নিচে রয়ে গেছে, আবার স্থানীয় লোকজন কিছু মৃত ও অর্ধমৃত মাছ নিয়ে গেছে। নিকট অতীতে দূষণের কারণে এত অধিকসংখ্যক মাছ মারা যাওয়ার নজির নেই। এ কারণে বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।’
‘নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে শুরু করে হাটহাজারী উপজেলা পর্যন্ত অনেকগুলো শিল্প কারখানা ও পোলট্রি খামার রয়েছে। এগুলোর বর্জ্য হালদার পানি দূষিত করছে। মাছ মারা যাচ্ছে। তিনটি খাল দিয়ে বর্জ্য পড়ছে নদীতে। পড়ছে এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য,’ বলেন এই গবেষক। হালদা দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র যেখানে কার্পজাতীয় মাছ বর্ষায় ডিম পাড়ে। চট্টগ্রাম ওয়াসা এই নদীর মিঠা পানি শোধন করে নগরীতে সরবরাহ করছে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/news/62804/