২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:১০

গ্রাহকরা বিপাকে

নেসার উদ্দিন। গত অক্টোবরে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান। গত ফেব্রæয়ারিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পীড়াপিড়িতে ব্যাংকে রাখেন পেনশনের টাকা। সুদের আয় দিয়েই সংসার চলছিল। সম্প্রতি ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে ৬ শতাংশ ঘোষণা দিয়েছে। যা ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নের কথা। নেসার উদ্দিন তাই এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কিভাবে সংসার চালাবেন। 

দীর্ঘ ২৫ বছর ব্রæনাই থেকে গত মার্চ মাসে দেশে আসেন সাঈদ হোসেন নামের এক প্রবাসী। দেশে আসামাত্র একাধিক ব্যাংকের কর্মীরা প্রায়ই সাঈদ হোসেনের কাছে যান। আমানত রাখলে অধিক সুদসহ নানা সুবিধার কথা বলেন। বাধ্য হয়েই অন্য কিছু চিন্তা না করে ব্যাংক কর্মীদের কথা অনুযায়ি আজীবনের সঞ্চয় রাখেন ব্যাংকে। হঠাৎ করে গত বুধবার আমানতের সুদহার কমানোর ঘোষণায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সাঈদ। তিনি ইতোমধ্যে ব্যাংকের ওই শাখায় যোগাযোগ করেছেন। তাকে ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছেÑওটা ঘোষণা মাত্র। এর প্রভাব আপনার টাকায় পড়বে না। ব্যাংক থেকে আশ্বস্ত করলেও তিনি অন্যভাবে জানতে পেরেছেন এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমানতের সুদহার কমে যাবে। তাই এখন ভাবছেন কিভাবে সংসার চলবে। সাঈদ হোসেন বা নেসার উদ্দিন এখন সঞ্চয়পত্রে নাকি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। সেখানেও রয়েছে সমস্যা। অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রে সুদের হার আগামী মাসে কমানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে দীর্ঘদিন থেকে শেয়ারবজারের অবস্থা নাজুক।
আর তাই সঞ্চয়নির্ভর অনেক পরিবারই এখন শঙ্কার মধ্যে আছেন। অথচ ব্যাংকগুলোতে এখনও উচ্চসুদে অন্য ব্যাংকের আমানতকারী ভাগিয়ে নিতে তৎপর ব্যাংক কর্মকর্তারা। ঋণ বিতরণ বন্ধ রেখে আমানতের জন্য গ্রাহকদের অফিসে কিংবা বাড়িতেও ছুটছেন তারা। দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকই গ্রাহকদের দুই অংকের ঘরে এমনকি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আমানত রাখার প্রস্তাব দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানত রাখলে উচ্চসুদের পাশাপাশি উপঢৌকনও দিচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই আমানতের সুদহার কমিয়েছিল। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদহার ২ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে এনেছিল। এ পরিস্থিতিতে গত ফেব্রæয়ারি থেকে আমানতের সুদহার বাড়ায় আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হন। আর বহুদিন পর ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে মূল্যায়ন পেয়ে ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহিত হচ্ছিল তারা। আমানতের সুদহার বাড়ায় খুশি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকও। শুধু গ্রাহক নয়, বরং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমানতের এ সংকটকে কাজে লাগিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও। কয়েকদিন আগেও মেয়াদি আমানতের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ১০ শতাংশের বেশি সুদ চেয়েছে এ ব্যাংকগুলো। কিন্তু হঠাৎ করে বিএবি’র ঘোষণা সবকিছু ওলট পালট করে দিয়েছে।
তারল্য সংকট পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল কথা হয় একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে। প্রত্যেকেই বলছেন, ব্যাংকিং খাতে আমানত সংকট এখনও বিদ্যমান। দুই অংকের সুদহার প্রস্তাব করেও গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। তাই হঠাৎ করে আমানতের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত এক ধরনের আত্মঘাতি। এ অবস্থায় গ্রাহকরা আমানত তুলে নিলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন তারা।
এছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের উদ্বৃত্ত টাকা অন্য ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা রাখে। এর বিপরীতে ৫-৭ শতাংশ সুদ পেয়ে আসছিল জমা রাখা ব্যাংকগুলো। কিন্তু আমানতের তীব্র সংকট তৈরি হওয়ায় কয়েকদিন আগেও ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংককে ধার দেয়া আমানত তুলে নিয়েছে। ফলে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত কম পাওয়া ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করছেন অনেক ব্যাংকার।
গত বুধবার বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নেতারা এক বৈঠকে ঋণ ও আমানতের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে সব বেসরকারি ব্যাংক, ঋণের বিপরীতে সুদ ৯ শতাংশের বেশি নেবে না। অন্যদিকে আমানতের সুদ ছয় শতাংশের বেশি দেবে না। যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদি ঋণের সুদহার সাড়ে আট থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ এবং তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার সাড়ে তিন থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত।
এদিকে বিএবি ঘোষণা দিলেও ব্যাংকগুলো এখনো অতিরিক্ত সুদ ও অন্যান্য উপঢৌকনের বিনিময়ে গ্রাহকদের আমানত নিচ্ছে। এখনও উচ্চসুদে অন্য ব্যাংকের আমানতকারী ভাগিয়ে নিতে তৎপর ব্যাংক কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের রাজধানীর একটি শাখা ব্যবস্থাপক জানান, আমানতের সুদের হার কমানোর ঘোষণা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ এখনো গ্রাহকদের ১৩/১৪ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা বলে আমরা আমানত নিচ্ছি। ব্যাংকের নীতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে আমানতে সুদহার কমানোর নির্দেশনাও পাইনি। তাই বিএবি’র আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের ঘোষণা বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তবে এটা বাস্তবায়িত হলে গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিবে। পাশাপাশি যে সব ব্যাংক কর্মী গ্রাহকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলে আমানত নিয়েছে তারাও বিপাকে আছেন। এ সব ব্যাংকার গ্রাহকদের কি বলবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগছেন।
মালিকদের এমন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক শীর্ষ ব্যাংকাররাও। অনেকের মতে, এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এই পরিবর্তনটা হয়তো খুবই সাময়িক। কয়েকদিন পর আবার অন্য চিত্রও দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান আছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বিশ্বের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করে দিতে পারে না। বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা বাজার অর্থনীতির উল্টো পথে চলা। প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদ নিজেরা বৈঠক করে সুদহার সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতেও হয়। এভাবে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে অনেক ব্যাংক, বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো ক্ষতিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সাবেক ব্যাংকারদের। তাদের বক্তব্য, এখন সুদহার কমানোর ঘোষণা এসেছে পরবর্তীতে হয়তো সুদহার বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়ে বসতে পারেন মালিকরা। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আইনে থাকুক আর না থাকুক, অর্থনীতির জন্য তা ইতিবাচক নয়। অথচ কিছুদিন আগেও তারল্য সংকটের কারণে উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহের কথা বলে ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। গ্রাহক ভাগানো নিয়ে এক ব্যাংকের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের বিবাদেরও ঘটনা আছে। যা এখনো চলমান আছে।
এর আগেও সুদ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিলেও তা মানেনি ব্যাংকগুলো। তাই শঙ্কা থেকে যায়, মালিকরা যখন প্রয়োজন মনে করবেন, তখন হয়তো সুদহার বাড়িয়ে দেবেন। তারাই যদি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজন কী?
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেছেন, ‘ব্যাংকের সুদহার কোনো অ্যাসোসিয়েশনের বেধে দেয়া ঠিক নয়, এটি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। বাজার নির্ধারণ করবে সুদহার কত হবে।
সূত্র মতে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ (্এপ্রিল)। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ি সে পরিমাণ সুদও বলতে গেলে পাবে না আমানতকারী। আর তাই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি ব্যাংকগুলো বছরের শুরু থেকে মুদ্রানীতিকে পাশ কাটিয়ে উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করে অনিয়ম-দুর্নীতির কারনে নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে অর্থের জোগান দিয়েছে। এই টাকাও কি ব্যাংকে থাকবে নাকি নির্বাচনের বছরে অন্য কোথায় চলে যাবে। কারণ এক বছর আগেও যেখানে অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে বিপাকে ছিল ব্যাংকগুলো। কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংক সব ধরনের আমানত প্রকল্পও বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখানে কয়েকদিন যেতে না যেতেই চলতি বছরের শুরুতে তারল্য সঙ্কটের কারনে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করা শুরু করে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেকেই এখন নিরুপায় হয়ে সঞ্চয়পত্র ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন। তবে সেখানেও নেই স্বস্তি। তাই হঠাৎ করে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার কমানোয় বিপাকে রয়েছেন নি¤œ মধ্যবিত্ত এবং আমনতের সঞ্চয় দিয়ে জীবন-যাপন করা পরিবারগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ইনকিলাবকে বলেন, ঋণ সুদহার কমাতে হলে আমানতে সুদহার কমাতে হয়। তবে আমনত রাখা গ্রাহকরা এক্ষেত্রে বিপাকে পড়বে কারণ আমাদের বন্ড ব্যবস্থা ভালো না যে গ্রাহক সেখানে বিনিয়োগ করবে। অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। আমাদের শেয়ারবাজারের অস্থিরতা তাই গ্রাহকদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগেরও সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সুদহার কমানো হয়েছে বলেছে বিএবি। এ প্রসঙ্গে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা ঠিক বলেনি। প্রধানমন্ত্রী হয়তো সুদের হার কমানোর অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে বিএবি একটি সংগঠন। তারা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রকও নয়; সুদহার তারা কোনভাবেই ঘোষণা করতে পারে না। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ সঙ্কেত। এর জন্য প্রত্যেকটা ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ রয়েছে। তারা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। কোন সমিতিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করতে পারবেনা। আর্থিকখাতে অস্থিরতা তৈরি হবে। এছাড়া ঘোষিত সুদহার বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলে উল্লেখ করে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, হয়তো কাগজে-কলমে দেখাবে, বাস্তবে থাকবে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, আমানতের সুদহার হঠাৎ করে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাধ্য হয়েও ব্যাংকেই টাকা রাখতে হবে। কারণ মানুষের টাকা রাখার জন্য বিকল্প নেই। যেখানে মানুষ বিনিয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের গ্রাহকরা সচেতন না বলেই টাকা ব্যাংকে রাখে। কিছু সচেতন গ্রাহক হয়তো এখন ব্যাংক থেকে উঠিয়ে জমি বা ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করবে। তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬ শতাংশ। আমানতের সুদের হারও নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। তাই যে কোন মূল্যে আমানতের সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের উপরে রাখতে হবে। তা না হলে ফান্ড মবিলাইজ হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র জী এম আবুল কালাম আজাদ ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আলোচনা করেই বিএবি সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য আলাদা কোন সার্কুলার জারি করা হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/138071/