২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:০৯

জোড়াতালির সড়ক মেরামত

ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা সড়ক-মহাসড়কের কারনে এবারের ঈদেও যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হলো। ঈদের আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ভাঙাচোরা সড়ক মেরামতের কাজ শেষ করা হয়েছে বলে সওজের দাবি। বেশিরভাগ কাজই জোড়াতালি দিয়ে করায় ঈদের পর সেগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এতে করে ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরতে গিয়ে আবার নতুন করে ভোগান্তি হানা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বছর বর্ষার আগে-পরে বা ঈদের আগে সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের আয়োজন করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদ উদযাপন শেষে ঢাকায় ফেরার পথে যাত্রীরা দেখেছে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা। বিশেষ করে ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বেহাল দশা সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে বলে ভুক্তভোগিদের অভিযোগ।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাঙাচোরা সড়ক মেরামত ও পুনর্নিমাণে আগামী পাঁচ বছরে প্রয়োজন ২১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে (২০১৮-১৯) প্রয়োজন ১৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। বিশেষষজ্ঞদের মতে, বছরজুড়েই সারাদেশে সড়ক-মহাসড়কের মেরামত কাজ চলে। এজন্য হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু মেরামতের কয়েকদিনের মধ্যেই আবার সেই আগের বেহাল অবস্থা ফিরে আসে। এতে প্রমাণিত হয় সড়ক-মহাসড়ক সংস্কারের নামে বড় ধরনের অনিয়ম হয়। যেটা কাগজে কলমে ধরা না পড়লেও বাস্তবে অনেকটাই স্পষ্ট হয়। এলজিইডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোঃ শহীদুল হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও প্রকৃত কাজে বরাদ্দের অর্ধৈক টাকাও যদি ব্যয় করা হতো তাহলে এমন অবস্থা হতো না। তিনি বলেন, সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের নামে চুরি ও অপচয় হয় বেশি। বরাদ্দকৃত টাকার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ চলে যায় ভিন্নখাতে। এর মধ্যে মাস্তান, চাঁদাবাজি, ডিপার্টমেন্টাল কমিশন, রাজনীতিকদের ভাগ, ট্যাক্সসহ আনুসাঙ্গিক খাত রয়েছে। এরপর যা থাকে তাও যদি সঠিকভাবে সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের কাজে ব্যয় করা হতো তবুও কাঙ্খিত ফল পাওয়া যেতো। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সুশাসন ও জবাবদিহিতার উপর গুরুত্বারোপ করে বিশেষজ্ঞ এই প্রকৌশলী বলেন, উন্নয়নের জন্য সুশাসন দরকার।
ঈদের আগে সড়ক ও জনপথের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের প্রায় ২৭ শতাংশ ভাঙাচোরা, যাতায়াত অনুপযোগী। মহাসড়কের ৫৭ ভাগ ভালো হলেও সারা দেশে দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়কের অবস্থা খারাপ, চলাচলের অযোগ্য। এসব সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার ও পুনর্নিমাণ করতে হবে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে এক হাজার ৭৩ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খারাপ। খুব খারাপ ক্যটাগরির সড়কও আগের বছরগুলোর তুলনায় বেড়েছে। এর প্রভাব পড়তে পারে ঈদযাত্রায়। এইচডিএম-এর সেই প্রতিবেদনের তথ্য সত্য প্রমানিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের ৫৩ ভাগ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো। আগের বছরে ভালো ছিল ৩৯ ভাগ সড়ক। সওজের প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশের ৯ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা ভালো, যা জরিপকৃত সড়কের ৫৩ দশমিক ৬৩ ভাগ। তিন হাজার ৬০৪ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা মোটামুটি। দুই হাজার ১১৫ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা দুর্বল। এইচডিএম প্রতিবেদনে জেলা সড়কের ৫১ ভাগ ভালো বলা হয়েছে, ২০ ভাগ মোটামুটি আর বাকি ২৯ ভাগই চলাচলের অনুপযোগী। মোট ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়কের মধ্যে ১০ হাজার ৩৯৩ কিলোমিটার জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ আর ৬৫৮ কিলোমিটারের অবস্থা খারাপ। চার হাজার ২৪৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের তিন হাজার ৮২১ কিলোমিটার জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ ভাগই ভালো। ১৯ ভাগ মোটামুটি অবস্থায় আছে আর বাকি ২৪ ভাগই চলাচলের অযোগ্য। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সওজের অধীন ১০টি জোনের মধ্যে সড়কের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বরিশালে। এ জোনের ৩২০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা খুব খারাপ।
সূত্র জানায়, জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়কÑএই ক্যাটেগরিতে সওজের অধীনে সারা দেশে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশের ১৭ হাজার ৯৭৬ কিলোমিটার সড়ক জরিপ করে এইচডিএম। জরিপের ভিত্তিতে ২০১৭-১৮ সালের প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাঙাচোরা সড়ক মেরামত ও পুনর্নিমাণে আগামী পাঁচ বছরে প্রয়োজন ২১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। যার মধ্যে আগামী অর্থবছরে প্রয়োজন ১৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
সওজ সূত্র জানায়, প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি যাতে না হয় সে জন্য ঈদের আগে ৮ জুনের মধ্যে সব সড়ক চলাচলের উপযোগী করার নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশে ৮ জুনের মধ্যে সড়ক-মহগাসড়ক মেরামত করা হয় ঠিকই। তবে সবই ছিল জোড়াতালি দিয়ে। খানাখন্দে ভরা সড়কে ইট বিছিয়ে তার উপর বিটুমিন দিয়ে কোনমতে চলাচলের উপযোগি করা হয়। সওজের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মেরামতের কাজে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় অনেক স্থানেই জোড়াতালি দিয়ে কাজ করা হয়েছে। ঈদের পর একদিনের বৃষ্টিতেই সবকিছু ধুয়ে মুছে আবার আগের অবস্থা হয়েছে। এলজিইডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোঃ শহীদুল হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন,সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের কাজ হচ্ছে না তা বলা যাবে না। কাজ হচ্ছে কিন্তু তা সঠিকভাবে হচ্ছে না। তিনি বলেন, একটা সড়ক মেরামত করা হলো। কিন্তু সেখানে যদি পানি জমে থাকে, তবে তা আবার ভাঙবে এটাই স্বাভাবিক। মেরামতের সাথে সাথে সেই স্থানে যাতে পানি না জমে সে ব্যবস্থা করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না বলেই একদিনের বৃষ্টিতে সব একাকার হয়ে যায়।
দূরপাল্লার রুটের বাসের চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেহাল সড়ক ঈদে ঘরমুখি যাত্রীদেরকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে বাসগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারেনি। এতে করে সময় লেগেছে কয়েক গুণ বেশি। আবার কোনো কোনো এলাকার সড়ক এতোটাই খারাপ যে, চলন্ত গাড়ির সীটে বসে থাকাও যন্ত্রনাদায়ক ছিল। রংপুরের একজন যাত্রী জানান, ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত মহাসড়কে অন্ত:ত দেড়শ’ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে একশ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। একই সাথে গাড়িরও ক্ষতি হচ্ছে, জ্বালানীও বেশি পুড়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই বেহাল সড়ক-মহাসড়কের কারনে পরিবহন ব্যবসায় ধস নামার উপক্রম হয়েছে। বেহাল সড়কে চলতে গিয়ে গাড়ির আয়ুস্কাল কমে যাচ্ছে। ঘন ঘন নষ্ট হচ্ছে গাড়ির চাকাসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। একই সাথে জ্বালানীর খরচ বেড়েছে, কমেছে ট্রিপের সংখ্যা। সব মিলে পরিবহন মালিকদের পথে বসার মতো অবস্থা।

https://www.dailyinqilab.com/article/138069/