২৩ জুন ২০১৮, শনিবার, ১১:৫৫

এলএনজি সরবরাহ অনিশ্চিত

পাইপলাইনের ত্রুটি ও গ্রিডে সংযোগের কাজ শেষ হয়নি

পাঁচ দফায় তারিখ পিছিয়ে জুলাইয়ে ‘সম্ভাবনা’
গ্যাস সঙ্কটে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত
শফিউল আলম : এলএনজি (ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ কবে শুরু করা যাবে তা আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভাসমান টার্মিনালযুক্ত এলএনজিবাহী বিশেষায়িত জাহাজ থেকে সাগরের তলদেশ দিয়ে মোহনায় স্থলভাগ পর্যন্ত পাইপলাইনের (সাব-সী) যান্ত্রিক ত্রæটি-বিচ্যুতি ও ফুটো ধরা পড়ে প্রায় দেড় মাস আগে। এর মেরামত কাজ শেষ হয়নি এখনও। পাইপলাইনের চট্টগ্রাম প্রান্তে উপকূল হয়ে সীতাকুÐে জাতীয় গ্রীডলাইনে সংযোগ সম্পন্ন করা যায়নি। তাছাড়া সাব-সী পাইপলাইন ও গ্রীডলাইনে কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার আরও প্রক্রিয়া বাকি। এসব যান্ত্রিক ও কারিগরি দিক গত সপ্তাহে সম্পন্ন করার সর্বশেষ টার্গেট ছিল পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষের। গতকাল (শুক্রবার) অথবা (শনিবার) পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহ শুরুর সম্ভাব্য তারিখও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় পাঁচ দফায় তারিখ পিছিয়ে এখন জুলাই মাসের মাঝামাঝি নাগাদ সরবরাহের ‘সম্ভাবনা’ দেখছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বিগত ২৪ এপ্রিল এলএনজিবাহী দেশে প্রথম ও এ যাবত সর্ববৃহৎ আকারের জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’ পৌঁছায়। এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ’ ঘনমিটার (৬০ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন) এলএনজি বহনকারী টার্মিনালযুক্ত জাহাজটি কাতার থেকে এলএনজির প্রথম আমদানি চালান নিয়ে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু জাহাজ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস রূপান্তর বা রি-গ্যাসিফিকেশন এবং সরবরাহ শুরু না হতেই দেখা দিচ্ছে একের পর এক বিপত্তি আর জটিলতা। আমেরিকান জ্বালানি কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির জাহাজটি মহেশখালীর মাতারবাড়ীর অদূরে সমুদ্রে নোঙর করে আছে।
জাহাজের সাথে যুক্ত টার্মিনাল থেকে সাগরের তলদেশে পাইপলাইন দিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপ হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহের লক্ষ্যে দিনক্ষণ গণনা চলেছে। এরজন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয় কয়েকবার। প্রথম দফায় ২৫ অথবা ২৬ এপ্রিল, দ্বিতীয় দফায় ১০ মে, তৃতীয় দফায় ২৬ মে, চতুর্থ বার ৬ থেকে ১২ জুনের মধ্যে এবং সর্বশেষ দফায় ২২ অথবা ২৩ জুন এলএনজি সরবরাহের তারিখ দেয়া হয়।

এদিকে এলএনজি সরাসরি খালাস ও সরবরাহের অপেক্ষায় গত প্রায় দুই মাস যাবত মহেশখালী সংলগ্ন সাগরে অলস নোঙররত রয়েছে জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’। এ অবস্থায় বেলজিয়ামের পতাকাবাহী বিশালাকায় এই জাহাজের পরিচালন ব্যয় (ফিক্সড অপারেটিং কস্ট) ও আনুষঙ্গিক খরচ, জাহাজকে সহায়তাকারী ৫টি টাগ পরিচালনা ব্যয় বাবদ দৈনিক ডেমারেজ বা লোকসান দিতে হচ্ছে ৪০ হাজার ডলার (প্রায় ৩৩ লাখ টাকা) হারে। পেট্রেবাংলা এলএনজির আমদানিকারক। ফলে সরকারকেই গুণতে হচ্ছে এই লোকসান। গত দুই মাসে ডেমারেজ বা লোকসান ২২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশ এবং মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে এলএনজির পরবর্তী চালান কবে আমদানি সম্ভব হবে তাও এখন অনিশ্চিত।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা, কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড)সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান এলএনজির দিকে তাকিয়ে। হাজার কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেও গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না নতুন স্থাপিত শত শত শিল্প-কারখানা। আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের অপেক্ষায় চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলে ২ হাজার ৩৯৪টি শিল্প, কল-কারখানা উৎপাদনে যেতে পারছেনা। এসব শিল্প-কারখানা এলএনজির উৎস থেকে গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তির অগ্রাধিকার ভিত্তিক তালিকায় রয়েছে।

কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, এলএনজি হ্যান্ডলিংয়ের পুরো বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা। তাও এটি স্পর্শকাতর বিষয়। ফলে এলএনজি সরবরাহ পাইপলাইনে দেয়ার আগেই আগাগোড়া প্রক্রিয়াটি ত্রæটি-বিচ্যুতি এবং সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত থাকাটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে নিয়োজিত প্রকৌশলী ও কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে গত সপ্তাহে আরেক দফায় কারিগরি প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। সাব-সী পাইপলাইন নির্মাণ কাজে যুক্ত এক্সিলারেট এনার্জির প্রকৌশলীরা ডুবুরির সহায়তায় গত প্রায় দেড় মাসে মেরামত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে সাগর উত্তাল থাকায় কাজ থেমে যায়।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্র জানায়, মহেশখালী জিটিসিএল-এর স্টেশন থেকে ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন দিয়ে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা হয়ে এলএনজির সরবরাহ জাতীয় গ্যাসগ্রীডের সঙ্গে যুক্ত হবে। টার্মিনাল থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিদিন ১শ’ মিলিয়ন (১০ কোটি) ঘনফুট এবং ধাপে ধাপে ৫শ’ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ১৫ বছরের চুক্তির আওতায় রি-গ্যাসিফিকেশন চার্জ নেবে এক্সিলারেট এনার্জি। সাগরে ভাসমান টার্মিনালের অবস্থান থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটারের সাব-সি পাইপলাইন দিয়ে এই গ্যাস জিটিসিএল-এর স্টেশনে সরবরাহ হবে।

কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ এবং সরবরাহ-পূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুÐ পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের আরও ৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। এ অংশে বিভিন্ন যান্ত্রিক ত্রæটি-বিচ্যুতি দেখা রয়ে গেছে। চট্টগ্রামের এ অংশে পাইপলাইন জাতীয় গ্যাস গ্রীডে যুক্ত হচ্ছে।

মাতারবাড়ী টার্মিনালের রি-গ্যাসিফিকেশন অর্থাৎ এলএনজি থেকে গ্যাসে রূপান্তরের ক্ষমতা দৈনিক ৫শ’ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ঘনফুট। দেশে বর্তমানে দৈনিক ৩৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ২৬৫ থেকে ২৭৫ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামে ৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে মিলছে মাত্র ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এলএনজি উৎস থেকে অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের ঘাটতি নিরসনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বাকি অর্ধেক যাবে জাতীয় গ্রীডে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/137707