২৩ জুন ২০১৮, শনিবার, ১১:৪৮

ছয় বছরে ছয়বার পাঠ্যবই পরিবর্তন

শিক্ষা ব্যবস্থায় তুঘলকি কাণ্ড

ঘন ঘন পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস * পাঁচ মাস আগে জেএসসিতে বিষয়-নম্বর সংস্কার * শিক্ষায় সুস্থির পদ্ধতি থাকা উচিত -ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ছয় বছরে একবার কারিকুলাম ও অন্তত ছয়বার পাঠ্যবই পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিও অসংখ্যবার পাল্টানো হয়েছে। দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি তিনবার বদলেছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা পদ্ধতিতে আবারও সংস্কার আনা হচ্ছে।
অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় নম্বর ও বিষয় কমিয়ে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত পরিবর্তিত বিষয়ের নম্বর বণ্টন প্রকাশ করা হয়নি। অথচ এ পরীক্ষার বাকি আছে মাত্র পাঁচ মাস। এ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণীর পিইসি পরীক্ষায় এমসিকিউ বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এই দুই পরীক্ষায় ২৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয়। আর পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যা হচ্ছে তা রীতিমতো তুঘলকি কাণ্ড। এমনটা চলা উচিত নয়। শিক্ষায় সুস্থির ব্যবস্থা ও পদ্ধতি থাকা উচিত।

তিনি বলেন, শিক্ষার এমন অবস্থায় বিদেশিরা এ দেশে চাকরি করতে এসে বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। বছরে চার হাজার ভারতীয় নাগরিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। যদি শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় স্থিরতা এবং সঠিক পদ্ধতি কায়েম করা না হয়, তাহলে আমাদের চাকরির বাজার দিন দিন আরও বেশি করে বিদেশিদের দখলে চলে যাবে। এখনই না জাগলে আমাদের জন্য ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে।
বিষয় ও নম্বর সমন্বয়ে গড়িমসি : ৩১ মে এবারের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার বিষয় ও নম্বর সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় এ পরীক্ষার নম্বর হবে ৬৫০। আর সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা হবে। গত বছর ৮৫০ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। গত বছর ১০টি বিষয়ে পরীক্ষা হয়।
মাদ্রাসার জেডিসিতেও বিষয় ও নম্বর কমানো হয়েছে। এখন উভয় পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র একীভূত হবে প্রথমপত্রে। এ কারণে নতুন প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বণ্টন পরীক্ষার্থীদের জানা জরুরি। সিদ্ধান্তের পর কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের টেনশনের শেষ নেই।

এদিকে, বারবার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ প্রশ্ন বাতিল করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে নানা ঘটনা ঘটে। প্রথমে এমসিকিউ রেখে ১৮ ফেব্র“য়ারি প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর ঠিক করে সার্কুলার জারি করা হয়। এর দেড় মাস পর ২ এপ্রিল এমসিকিউ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও ১০ দিন পর নতুন নিয়মে প্রশ্নপত্রের কাঠামো আদেশ জারি হয়।
শুধু প্রাথমিক নয়, শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও নানা ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ২০১৬ সালে পরীক্ষার কয়েকদিন আগে হঠাৎ ঘোষণা করা হয়, সৃজনশীলের আগে এমসিকিউ পরীক্ষা নেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষা পদ্ধতি বিষয়ে আগে জানার অধিকার আছে শিক্ষার্থীদের। তিনি বলেন, পরীক্ষা পদ্ধতি ঘন ঘন পরিবর্তন ও প্রবর্তন করার এখতিয়ার সরকারকে কেউ দেয়নি। কেননা, পরীক্ষার ব্যাপারে প্রথম স্টেকহোল্ডার বাবা-মা, এরপর সমাজ। তারপর রাষ্ট্র। শিক্ষার্থীরা আরও বড় স্টেকহোল্ডার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- শুধু কারিকুলাম, পাঠ্যবই, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নয়, শিক্ষার অন্য দিকেও ঘন ঘন কাটাছেঁড়া চলছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে এক শ্রেণীর আমলা ও কলেজ পর্যায়ের গুটিকয়েক শিক্ষক বিদেশ ঘুরে বেড়ান। দেশে ফিরে জাতীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় না নিয়ে তারা অনেক কিছু চাপিয়ে দেন। ফলে বিদেশ থেকে ধার করা ওইসব পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চালু হয়।

ঘন ঘন পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থী-অভিভাবক দূরের কথা, বেশিরভাগ শিক্ষকই খাপ খাওয়াতে পারেন না। এতে বিপাকে পড়েন তারা। ফলে খুঁড়িয়ে চলে শিক্ষাব্যবস্থা। জোড়াতালির ক্লাস কার্যক্রমের ক্ষতি পোষাতে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ামুখী হতে হয় শিক্ষার্থীকে।
পরীক্ষা পদ্ধতি : দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও অন্তত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে- গ্রেডিং পদ্ধতি, এসবিএ (স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন) ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন। ২০০৭ সালে এসবিএ চালু হলেও সমালোচনার মুখে এক বছরেই তা স্থগিত হয়। এখন ধারাবাহিক মূল্যায়নের নামে এ পদ্ধতি আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা, ক্যারিয়ার শিক্ষা বিষয়ে এটি চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গলার ফাঁস এমসিকিউ : ১৯৯২ সালে এসএসসিতে এমসিকিউ পদ্ধতি চালু করা হয়। এতে প্রতি বিষয়ে ৫০০টি এমসিকিউ প্রশ্ন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এমসিকিউ ও রচনামূলক মিলিয়ে শুরুতে ৩৩ নম্বর পেলে পাস ধরা হতো।

ফলে একশ্রেণীর শিক্ষার্থী রচনামূলক অংশের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে শুধু ৫০০টি এমসিকিউ মুখস্থ করে পাস করে যেত। এতে পাসের হার রাতারাতি বাড়লেও শিক্ষার মান পড়তে থাকে। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে প্রশ্ন ব্যাংক তুলে দিয়ে গোটা বই থেকে এমসিকিউ করা হয়। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার হলে বলে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে।
এরপর এমসিকিউর পূর্ণ নম্বর কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। কিন্তু জেঁকে বসা দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। ফলে গত বছর এসএসসি থেকে এমসিকিউ প্রশ্ন ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও দুর্নীতি পিছু ছাড়েনি। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে এমসিকিউ তুলে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।

সৃজনশীল পদ্ধতি : শিক্ষা পদ্ধতিতে সবচেয়ে ওলট-পালট করা পরিবর্তনের নাম ‘সৃজনশীল শিক্ষা’। সনাতনী পদ্ধতিতে পাঠ্যবইয়ের শেষে প্রশ্ন থাকত। শিক্ষার্থীরা পাঠ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে লিখত। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা, কোচিং-প্রাইভেট ও নোট-গাইড বন্ধ করতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলেও বাস্তবে এসবের মাত্রা আরও বেড়েছে। সৃজনশীলে চারটি অংশ নিয়ে একটি প্রশ্ন হয়। চতুর্থ অংশ মুখস্থ করতে হয়।
এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দেয়ায় তারা ক্লাসে ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না।
সরকারি সমীক্ষামতে, ২০০৫ সালে এ পদ্ধতি চালু হলেও ১২ বছরে ৫৬ শতাংশ শিক্ষক এটি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। শিক্ষকরা এ পদ্ধতি না বোঝায় কমার্শিয়াল কোচিং সেন্টার বিস্তার লাভ করে। পাশাপাশি শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসাও বেড়েছে। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

কারিকুলাম ও পাঠ্যবই : নতুন কারিকুলামের আলোকে ২০১৩ সালে শিশুদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়া হয়। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ ও চলতি বছরও এসব বই পরিমার্জন-পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে এ বছর পাঠ্যবই পরিবর্তন নিয়ে সুধীমহলে ব্যাপক আপত্তি উঠেছে।
অনেকের অভিযোগ- হেফাজতে ইসলামের দাবি আমলে নিয়ে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের অধীনে প্রবর্তিত বই ও নতুন বিষয় নিয়ে শোরগোল ওঠে। এ কারণে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ পাবলিক পরীক্ষা থেকে বিষয়গুলো তুলে নেয়া হয়। এখন এগুলো ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে স্কুল-মাদ্রাসা পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হবে। আইসিটি বিষয় চালু করলেও এর শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। ফলে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এ শিক্ষা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সারা বিশ্বে প্রতি ৫-৭ বছর পরপর কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়। ২০১২ সালে যখন এ কারিকুলাম প্রবর্তন করা হয়, তখন ২০১৭ সালে এটি পর্যালোচনার কথা ছিল।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/61966