মুক্তিপণের টাকা গুনে নিচ্ছেন ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার এসআই লুৎফর ইনসেটে মুক্তিপণের দাবিতে পাঠানো মেসেজ ও অপহৃত কিশোর :
২৩ জুন ২০১৮, শনিবার, ১১:৪২

পুলিশের সামনে মুক্তিপণ নিলো অপহরণকারীরা

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় শিশু অপহরণের পর পুলিশের উপস্থিতিতে মুক্তিপণের টাকা নিয়ে নির্বিঘেœ চলে গেছে অপহরণকারী। শুধু তা-ই নয়, অপহরণকারীদের দেয়ার আগে দাবিকৃত মুক্তিপণের টাকাও গুনে দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরাই। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। মুক্তিপণের টাকা গুনে দেয়ার ছবি থাকার পরেও পুলিশ এখন অস্বীকার করছে বিষয়টি। আর পুলিশের অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও সদস্যরাও মুক্তিপণের টাকা দেয়ার সময় তাদের উপস্থিতির বিষয়টি অস্বীকার করছেন।

ঘটনাটি ঘটেছে নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের চর মানিকদি পাগলপাড়া গ্রামে। এ ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে সন্তানকে উদ্ধারে সব মহলের সহযোগিতা কামনা করেছে অপহৃত কিশোরের মা ও পাগলপাড়া গ্রামের সাইপ্রাস প্রবাসী আবুল হোসেন মাতুব্বরের স্ত্রী জান্নাতি বেগম। ফরিদপুর প্রেস কাবে আজ শুক্রবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে সন্তানকে উদ্ধারের আকুতি জানান তিনি। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

লিখিত বক্তব্যে জান্নাতি বেগম বলেন, তার বড় ছেলে আলাউদ্দিন ওরফে অন্তর মাতুব্বর তালমা নাজিমউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। গত ৭ জুন বৃহস্পতিবার তারাবি নামাজ পড়ার জন্য রাত ৮টার কিছু আগে বাসা হতে বের হয়। এরপর সে আর বাসায় ফিরেনি। তবে তিনবার তার সাথে মোবাইলে কথা হয়। রাত ১০টার পর থেকে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ৮ জুন রাতে নগরকান্দা থানায় একটি জিডি করা হয়।
এ দিকে থানায় জিডি করার পর বাসায় ফেরার পরই অন্তরের মোবাইল থেকে জান্নাতির মোবাইলে একটি ম্যাসেজ পাঠানো হয়। তাতে অন্তরকে অপহরণের কথা জানিয়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। একাধিকবার ফোন করে ও ম্যাসেজ পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ০১৮৭৬৭৬৮১২৮ নম্বরে পাঁচ লাখ টাকা বিকাশ করে পাঠাতে বলে। র্যািব-পুলিশকে জানাতে নিষেধ করেছিল তবে ঘটনার পরপরই ৮ জুন তিনি পুলিশ ও র্যাঠব অফিসে গিয়ে অন্তরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে আসেন।

সর্বশেষ ১৪ জুন আবারো অন্তরের মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে মুক্তিপণের টাকা নিয়ে ভাঙ্গার একটি প্রইমারি স্কুলের ঠিকানায় যেতে বলে। কিছুক্ষণ পর তাদের ভাঙ্গার বদলে তালমা জাইল্যা ব্রিজের নিকট এবং তারপর কোনাগাঁও চকের একটি শ্যালোমেশিন ঘরের মধ্যে টাকা রেখে আসতে বলে।
জান্নাতি বলেন, তখন রাত হয়ে গিয়েছিল। আমাকে একা যেতে বলেছিল। কিন্তু আমার ভয় করছে জানিয়ে কান্নাকাটি করলে তারা আমার সাথে দু’জন লোক নিয়ে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়। আমি নগরকান্দা থানার এসআই কবির দারোগা ও অন্য দু’জন পুলিশকে নিয়ে সেখানে যাই। পুলিশদের আড়ালে দাঁড় করিয়ে মাত্র ১৫ গজ দূরে মেশিন ঘরের মধ্যে একটি হাঁড়ির মধ্যে মুক্তিপণের ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা রেখে আসি।

জান্নাতি বলেন, ‘এ সময় আমি ও অন্য দুই পুলিশ কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই, ছোট্ট টর্চের আলো জ্বালিয়ে দু’জন লোক মেশিন ঘরে টাকা খুঁজছে। পুলিশ ও তাদের দেখে।’
‘টাকা যায় যাক, এখন ওদের ধরা যাবে না। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যাবে কিন্তু ছেলে গেলে ফিরে আসবে না।’ পুলিশরা তাকে এ কথা বলে জান্নাতি জানান।
এই সময় অদূরে রাস্তায় পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন বলে জান্নাতি বেগম সাংবাদিকদের জানান। ওই কর্মকর্তা তাকে টাকা দিতে নিষেধ করেননি। অপহরণকারীরা পুলিশের সামনেই মুক্তিপণের ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। এরপর ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে বললে প্রথমে অপহরণকারীরা জানায়, আধঘণ্টা পর ছেলেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাবে। পরে জানায়, পাশের বিলনালিয়া গ্রামের জনৈক খোকন তার ছেলের সন্ধান জানে।

জান্নাতি বেগম লিখিত বক্তব্যে জানান, অপহরণকারীদের দেয়ার আগে মুক্তিপণের টাকা গুনে দেখেন নগরকান্দা থানার সার্কেল ইন্সপেক্টর সাইফুল। যার একটি ছবি ও ভিডিও তিনি সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। টাকা দেয়ার আগে তিনি তার পরিবারের লোকজন ও পুলিশকে নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে তিনি জানান।
এ দিকে মুক্তিপণ দিয়েও সন্তানকে ফিরে না পেয়ে বিলনালিয়ার মোবারক মাস্টারের ছেলে খোকন মাতুব্বরকে (৩৫) প্রধান আসামি করে ১৬ জনের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা করেন জান্নাতি বেগম।
অন্তরের খালাতো ভাই সাইফুল ইসলাম সাব্বির জানান, ওই মামলায় পুলিশের কোনো তৎপরতা না দেখে তারা স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার দ্বারস্থ হন। এরপর ওই নেতার নির্দেশে খোকনসহ আলতা মাতুব্বরের ছেলে কামাল মাতুব্বর (২৮) ও আক্তার মাতুব্বরের ছেলে সুজন (২৭) থানায় গেলে পুলিশ তাদের আটক করে।

এ ব্যাপারে জানতে নগরকান্দা থানার সার্কেল ইন্সপেক্টর সাইফুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, টাকা গুনে দেয়াতো দূরের কথা, মুক্তিপণের টাকা দিয়েছে কি না কিংবা কোথায় দিয়েছে তাই তিনি জানেন না।
নগরকান্দা থানার ওসি সৈয়দ লুৎফর রহমান জানান, এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনজনকে আটক করা হয়েছে। মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেল) মহিউদ্দিন জানান, ৯ জুন অন্তর মোটরসাইকেলে ফরিদপুরে আসে বলে জানতে পেরেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি টাকা দিতে না করেছিলাম।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/327130