২২ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ১১:৫০

পলাশী সিরাজ ও মীর জাফর

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : ১৭৫৭ সালে পলাশীর কথিত যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয় এবং ট্রাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়েছিল। আর এই ষড়যন্ত্রের কুশীলব ছিলেন মীর জাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম, ইয়ার লতিফ ও উমিচাঁদ গংরা। নবাব সিরাজের পতনের মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতনের সূচনা হয়েছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ও শেষ মোঘল স¤্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসনের মাধ্যমে সে ষড়যন্ত্রের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল। পলাশী যুদ্ধে ট্রাজিক হিরো নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের গোড়া পত্তন ঘটে। ফলে আমাদেরকে প্রায় ২শ বছর বিদেশী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছিল।
যে কারণেই হোক পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজয় বরণ করেছিলেন। ইতিহাস কখনো বিজিতের পক্ষে রচিত হয় না। বিশ্ব ইতিহাসে এমন নজীর কালেভদ্রেও দেখা যায় না। কিন্তু শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমই বলতে হবে। তিনি পলাশীর ভাগ্যবিড়ম্বনার পর ইতিহাসে মহানায়ক হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। তাই নবাব সিরাজ সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র; ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। পক্ষান্তরে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও মীর জাফর গংরা এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তারা ইতিহাসের অংশ হতে পারেননি। বিশ^ ইতিহাস যেমন কোম্পানি শাসনকে অপশাসন-দুঃশাসন ও লুটপাটের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে মীর জাফরকেও বিশ^াসঘাতক ও খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত করেছে। তাই মীর জাফর আর বিশ^াসঘাতকতা সমার্থক হয়ে গেছে। সিরাজের নাম শুনলে মানুষ যেমন শ্রদ্ধাবনত হয়, ঠিক তেমনিভাবে মীর জাফরের নামে মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। আর এটা উভয়পক্ষের জন্য যথার্থ পাওনা। এ ক্ষেত্রে ইতিহাস কোন পক্ষের ওপরই অবিচার করেনি।
পলাশী যুদ্ধ নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। দেশী-বিদেশী ফরমায়েসী লেখক ও তথাকথিত গবেষকরা শহীদ নবাব সিরাজের চরিত্র হননের জন্য কসরতও কম করেন নি। কিন্তু তা মানুষের কাছে বিশ^াস ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি বরং নবাবের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বেড়েছে। বেড়েছে বললে ভুল হবে বরং ইতিহাসই তাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে। মূলত এসব ফরমায়েসী লেখক-গবেষকরা নবাবের চরিত্র হনন করে মীর জাফরের অপরাধকে কিছুটা লঘু করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু এতেও তারা সফল হননি। নবাব সিরাজ একজন রক্তমাংসে গড়া মানুষ ছিলেন। তাই তার ওপর অতিমাত্রায় দেবত্ব আরোপ করার সুযোগ নেই। তিনি কখনোই মানবীয় ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু মীর জাফরসহ ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের অপকর্মকে আড়াল করার জন্য তার ওপর যেসব অসুরত্ব আরোপ করেছিল সে সবের প্রায় শতভাগই ছিল মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ষড়যন্ত্রকারীরা তার ওপর অতিমাত্রায় অসুরত্ব আরোপ করতে গিয়ে তার মানবীয় ভুলত্রুটিগুলো ঢেকে দিয়েছেন। তাই মানব সিরাজ সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই অতিমানবে পরিণত হয়েছেন। যা সম্ভব হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কারণেই।
যাহোক শহীদ নবাব সিরাজকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও মীর জাফর যে সঠিক কাজটি করেছিলেন একথা কেউ বলেন না। তাকে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেক কথা বলা হলেও উপসংহার তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। তাই দেখা যায় মীর জাফরের বংশধরেরাও নবাব সিরাজের সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। কিন্তু মীর জাফরের কবরে তাদেরকে ঘটা করে তা করতে দেখা যায় না। মীর জাফর যে সঠিক কাজটি করেছিলেন তারা এমন দাবিও কখনো করেন নি। বড়জোর নবাব সিরাজ অত্যাচারি ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ শাসক ছিলেন একথা তাদের মুখে শোভা পায়। ইতিহাস পর্যালোচনায় সেসব অভিযোগও অসার বলেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু এমন কথিত অত্যাচারি শাসকের করুণ পরিণতির পর যারা ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন তারা প্রজাদের অতীতের চেয়ে ভাল কি উপহার দিয়েছিলেন তা নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই। মূলত সিরাজের পতনের পর মীর জাফর তো প্রজাদেরকে সুশাসন উপহার দিতে পারেইনি বরং বাংলা স্বাধীনতাই হারিয়ে বসেছিল। ইন্দ্রিয়পরায়নতা ও ভোগ-বিলাস কাকে বলে তা মীর জাফর ও পুত্র মিরন তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তারা সুশাসন উপহার দেয়া তো দূরের কথা শাসন ক্ষমতাও তারা ধরে রাখতে পারেননি বরং তারা এখনও পলাশী ট্রাজেডির সুবিধাভোগী। বিশ্বাস ঘাতকতার পুরস্কার স্বরূপ আজও সৈয়দ আব্বাস আলী মির্জা মুর্শিদাবাদের প্রতীকী নবাব। এমন নবাবীতে কোন গৌরব নেই বরং আছে আত্মপ্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক। হয়তো তারা তা উপলব্ধিই করতে পারছেন না। আমাদের দুর্ভাগ্যটা তো সেখানেই।

পলাশীর ট্রাজেডির আড়াই শতক পরে এসে মীর জাফরের উত্তরসূরীদের সে বিষয়ে মূল্যায়ন ও আত্মোপলব্ধি কী বিষয়টি জানার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। জানা যায়, বাংলাদেশে নাকি মীর জাফরের বংশধররা বসবাস করেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তারা স্বীকারই করতে চাননি যে তারা মীর জাফরের বংশধর। ভারতের পশ্চিম বাংলায় মীর জাফরের উত্তরসূরীদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। মীর জাফরের অধঃস্তন জনাব সৈয়দ আলী রেজা মীর্জার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি বা তাদের বক্তব্য ও অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি। শুধু পরোক্ষভাবে এতটুকুই জানা গেছে তারা মনে করেন নবাব সিরাজ অত্যাচারি ও ইন্দ্রিয়পরায়ন শাসক ছিলেন। কিন্তু সিরাজ পরবর্তী সময়ে তারা প্রজাদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভাল কী করেছিলেন তা নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও সুবিধা করা যায়নি। তাই সার্বিক বিবেচনায় মনে হয়েছে মীর জাফর আলী খানের বংশধররা পলাশী ট্রাজেডির সুবিধাভোগী হলেও আত্মপক্ষ সমর্থন করা যৌক্তিক মনে করেন না বা সার্বিক প্রেক্ষাপটও তাদের জন্য অনুকূল নয়।
সাম্প্রতিক সময়ের অনুসন্ধানে মীর জাফরের আত্মপক্ষ সমর্থন বিষয়ক কিছু কথা আমার গোচরীভূত হয়েছে। যা মীর জাফরের বংশধরদের পরোক্ষ আত্মপক্ষও বলা যেতে পারে। এমন দাবিই করা হয়েছে একটি অনলাইন পোর্টালে। যেখানে ইনিয়ে-বিনিয়ে মীর জাফরের কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। আর মীর জাফর আলী খানকে ইংরেজদের বিপক্ষে প্রথম বিদ্রোহী বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও এই দাবির পক্ষে ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সকলকেই বিস্মিত বা হতবাক করেছে। কারণ, পলাশী ট্রাজেডির পর নবাবের চরিত্র হননের জন্য নানা কথা বলা হলেও মীর জাফরের পক্ষে কাউকে কথা বলতে শোনা যায় নি। কিন্তু সম্প্রতি কিছু অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে মীর জাফরের কাজের সাফাই গেয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রকাশিত হচ্ছে। যা আত্মসচেতন মানুষকে বেশ হতবাকই করেছে। আর এসব মীর জাফরের আত্মপক্ষ বলেই এখন মনে করা হচ্ছে।
অনলাইন পোর্টালে দাবি করা হয় যে, মীর জাফর যে দেশকে বিদেশি শাসকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এমন দাবি ঠিক নয়। কারণ, বাংলা, বিহার উরিষ্যা মীর জাফর বা সিরাজের নিজের দেশ ছিল না। তাদের পূর্ব পুরুষরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এদেশে এসেছিলেন। তারা বলতে চাচ্ছেন যে, ইংরেজরা যেমন এদেশে দখলদার, ঠিক তেমনিভাবে মীর জাফর ও নবাব সিরাজরাও এদেশে দখলদার। তাই শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে থাকা আর মীর জাফর বা সিরাজের হাতে থাকার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু তাদের এই দাবি কোন মানদন্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ইংজেরা এদেশ দখল করে নিয়ে কলোনী বানিয়ে অপশাসন ও দুঃশাসন চালিয়ে এদেশকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন এবং তাদের এ অপশাসন ও দুঃশাসন প্রায় ২শ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু নবাব সিরাজ ও তার পূর্বসূরীরা এমন গর্হিত কাজ কখনোই করেন নি।

নবাব সিরাজের পূর্বপুরুষরা মধ্যপ্রাচ্যের হলেও তারা এদেশকে নিজের দেশ হিসেবে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। সিরাজের জন্মও হয়েছিল এই রূপসী বাংলায়। তাই বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ছিল তার মাতৃভূমি। একই কথা মীর জাফরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই একথা প্রমাণ হয় যে, নবাব সিরাজ বা মীর জাফর এদেশেরই লোক ছিলেন। তাই পূর্বপূরুষরা মধ্যপ্রাচ্যের লোক ছিলেন এই কথা বলে সিরাজের দেশপ্রেমকে ছোট করা এবং মীর জাফরের অপরাধকে লঘু করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। ভারতের আর্য ও আর্য শাসকরা ভারতের লোক ছিলেন না। তারাও বাইরে থেকে ভারতে প্রবেশ করেন। সিরাজকে বিদেশী বলা হলেও এরাও সকলে বিদেশী। মোঘল স¤্রাটরাও উজবেকিস্তানের লোক ছিলেন। তারা দীর্ঘদিন ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। তাদেরকে কখনোই দখলদার হিসেবে মনে করা হয় না। তাছাড়াও বর্তমান সময়ে এক অনেক নজীর রয়েছে। অন্য দেশে জন্মগ্রহণ করেও ভিন্ন দেশকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে রাষ্ট্রের শীর্ষপদ পর্যন্ত অলঙ্কৃত করেছিলেন। তাই জন্মস্থানের ভিন্নতার প্রশ্ন তুলে কারো অবদানকে অস্বীকার করা বা কারো অপরাধকে লঘু করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, জগৎ শেঠরা কিন্তু ভিনদেশী ছিলেন না। আর পলাশী ষড়যন্ত্রে নেপথ্যচারী তারাই।
দাবি করা হয়েছে যে, ‘...... ইংরেজরা মীরজাফরকে সাহায্য করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাকে ক্ষমতায় বসার জন্য। বিনিময়ে তারা এই অঞ্চলে বিনা শুল্কে ব্যবসা করতে পারবে এবং রাজকোষ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা যুদ্ধের খরচ হিসাবে পাবে। যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র ইংরেজরা তাদের ভোল পালটে ফেলে এবং বিনা শুল্কে ব্যবসার সাথে সাথে নতুন নবাবের ক্ষমতার দিকেও হাত বাড়াতে থাকে। মীরজাফরের খুব শিঘ্রই মোহভঙ্গ হয় এবং ইংরেজদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। এই সময়, ডাচরা তার সাথে হাত মিলায় এবং উনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। তবে যুদ্ধের পর তারা মীরজাফরেরই জামাতা মীর কাসেমকে ক্ষমতায় বসায়। ৩ বছর পর আবার মীর কাসেম সরিয়ে মীরজাফরকে ক্ষমতায় বসায়’।

মীরজাফর যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন উপরের বক্তব্যে বিষয়টি খুবই সুষ্পষ্ট। নবাব সিরাজ ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি না দেয়ার কারণেই ইংরেজদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু মীর জাফর ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যের শর্তে এবং রাজকোষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে ইংরেজদের সহযোগিতা লাভ করেন। দাবি করা হচ্ছে যে, ইংরেজরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে নবাবের ক্ষমতার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। আর এখানেই মীর জাফরের অদূরদর্শিতা ও অজ্ঞতা খুবই স্পষ্ট। যারা বাণিজ্য করতে এসে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তারা মীর জাফরকে ছেড়ে কথা বলবে এমন বিশ্বাসই মীর জাফরকে অথর্ব ও যোগ্যতাহীন প্রমাণ হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।

দাবি করা হচ্ছে যে, মীর জাফর ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী। এমন দাবিও ইতিহাস সম্মত নয়। মীর জাফরকে ইংরেজরা ক্ষমতাচ্যুত করে বিদ্রোহী হওয়ার জন্য নয় বরং অপদার্থতা ও অযোগ্যতার কারণে। মূলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেছিলেন মীর জাফরের জামাতা মীর কাসেম আলী খান। কিন্তু তিনি বড় অসময়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। নবাব সিরাজকে হত্যার পর কোম্পানির হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিয়ে তা উদ্ধার করার মত ক্ষমতা মীর কাসেমদের হাতে ছিল না। বক্সারের যুদ্ধে তো খোদ মীর জাফরই জামাতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। এমনটি না হলে হয়তো ইতিহাস ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারতো। কিন্তু মীর জাফরের কারণেই বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসেমকে পরাজিত হতে হয়েছিল। আর যুদ্ধে ইংরেজদের দ্বিতীয়বার সহায়তা করার কারণেই দ্বিতীয়বার তিনি পুতুল নবাব হতে সমর্থ হয়েছিলেন।

মীর জাফরের অপরাধকে লঘু করার জন্য দাবি করা হচ্ছে যে, ‘....বিশ্বাসঘাতকতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এগুলি ছিল সেই সময়ের তথা মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহ-নবাবদের জীবনধারারই একটা অংশ যা থেকে কেউই মুক্ত নয়। তাই কাউকেই ধোয়া তুলসীপাতা বলা যায় না। নবাব সিরাজের মাতামহ নবাব আলীবর্দী খান বিশ^াসঘাতকতা করে সরফরাজ খানের কাছ থেকে নবাবী কেড়ে নিয়েছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, সরফরাজ খান ভাগীরথী নদীর তীরে গিরকার যুদ্ধে নিহত হন। তার প্রতিপক্ষ আজিমাবাদের (বর্তমান পাটনা) সুবেদার আলীবর্দী তাকে সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকেই সরফরাজ খান গুলিবিদ্ধ হন কিন্তু তার সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আলীবর্দী খানের নিপুন রণকৌশলের কাছে সরফরাজের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, মধ্যযুগে ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতিতেই রাজনৈতিক শক্তির উত্থান-পতন ঘটতো। আর সে নীতির ধারাবাহিকতায় ‘গিরকা’র যুদ্ধে নবাব সরফরাজ আলী খানের পতন ঘটেছিল আলীবর্দী খানের কাছে। কিন্তু গিরকার যুদ্ধের সাথে পলাশী যুদ্ধের তুলনা করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ, পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজের প্রতিপক্ষ মীর জাফর নন বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেনাপতি হিসেবে মীর জাফর নবাব সিরাজের পক্ষেই যুদ্ধ করবেন এটাই যৌক্তিক ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেই সাহায্য করেছিলেন। মীর জাফর যদি শুধুমাত্র নবাবী লাভের জন্য নবাব সিরাজের সাথে নিজেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন তবে মধ্যযুগের নিয়ম অনুযায়ী কেউ সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতেন না। কিন্তু তার সে যোগ্যতা বা সাহসই ছিল না বরং তিনি কাপুরুষের মত বিদেশীদের সাথে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রয়াসী হয়েছেন। যা মধ্যযুগের রাষ্ট্রাচারেও কাপুরুষতা ও অপরাধ হিসেবে গণ্য।

মীর জাফর আলী খান সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছিলেন পলাশী পরবর্তী হত্যাযজ্ঞ ও নির্মমতা নিয়ে। গিরকার যুদ্ধ ক্ষেত্রেই সরফরাজ আলী খানের মৃত্যু হয়েছিল। সরফরাজ খান মৃত্যুর সময় পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু আলীবর্তী খান তাদের ওপর নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা চালাননি। নবাব সিরাজ পলাশী যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিহত হননি বরং তিনি নিজ প্রাসাদে ফিরতে সমর্থ হয়েছিলেন। একজন পলায়নপর (তাদের ভাষায়) মানুষকে আটক করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বরং তা রীতিমত কাপুরুষতা। মীর জাফররা এমন কলঙ্কিত কাজটিই করেছিলেন। শুধু তাই নয়, পলাশী পরবর্তী সময়ে নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল সিরাজ পরিবারে ওপর। এরপরও যারা জীবিত ছিলেন তাদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন ও হিরাঝিল প্রাসাদে গণলুন্ঠন চালানো হয়েছিল। যা কোন শাসকের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

মূলত সরফরাজ খানের পর নবাব আলীবর্দী সুশাসন উপহার দিয়েছিলেন। তাই গিরকা ট্রাজেডির কথা কেউ মনে রাখেনি। পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফর যদি প্রজা সাধারণের জন্য সুশাসন উপহার দিতে পারতেন তাহলে হয়তো নবাব সিরাজের সাথের বিশ^াসঘাতকতার কথা সকলেই ভুলে যেতেন। তাছাড়া আরো একটা কারণে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতক আখ্যা পেয়েছেন। সেটা হলো, এখনও মানুষের ঘৃণা কুড়াচ্ছেন। সেটা হলো, তিনি বিদেশী শক্তির সাথে যোগসাজশ করেছেন, তাদের হাতের পুতুল হয়েছেন এবং বাংলা বিদেশী শক্তির উপনিবেশ হবার নিমিত্ত হয়েছেন। কিন্তু পলাশী পরবর্তী সময়ে মীর জাফর গং ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা শহীদ নবাব সিরাজকে মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই মীর জাফরের পক্ষে যত কথাই বলা হোক না কেন তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বরং তার বিশ^াসঘাতকতা আরও বেশি স্পষ্ট করে তোলে।
মীর জাফরের অপরাধকে লঘু করার জন্য নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে অনেক কল্পকাহিনী রচনা করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিযোগ হলো অন্ধকূপ হত্যাকান্ড। যা ইতিহাস পর্যালোচনায় আলীক ও অসার বলেই প্রমাণিত হয়।

ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার ‘ইংরাজের জয়’ গ্রন্থে লেখেন, ‘অন্ধকূপের বিবরণ অলীক। তবে সিরাজদ্দৌলার যে কলিকাতা আক্রমণ করিয়া ইংরাজকে তাড়াইয়া ছিলেন ইহা সর্ববাদি সম্মত।’ কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করে বিহারীলাল বলেন যে, সিরাজকে কালিমালিপ্ত করে ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী আকাক্সক্ষা প্রতিষ্ঠার কারণেই হলওয়েল মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদ ভোলানাথ প্রমাণ করেছিলেন যে, অন্ধকূপের ২৬৭ বর্গফুট আয়তন ১৪৬ জন পূর্ণবয়স্ক ইউরোপীয় সৈন্যের ধারণ ক্ষমতার বাইরে ছিলো। ১৮ ফুট ও ১৫ ফুট আয়তন বিশিষ্ট একটি স্থানকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে ইউরোপীয়দের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ১৪৬ জন বাঙালি কৃষককে ঠাসাঠাসি করেও ঢোকাতে তিনি ব্যর্থ হন। আর হলওয়েল মনুমেন্ট ১৮১৮সালে ভেঙ্গে ফেলে আবার ১৯০২ সালে পুনঃস্থাপন এবং ১৯৪০ সালে পুনরায় প্রত্যাহারের মাধ্যমে ইংরেজরাও ঘটনার অসারতা মেনে নিয়েছেন।

মূলত শহীদ নবাব সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী; মহানায়ক। দুর্ভাগ্য যে, আমরা তার যথাযথ মূল্যায়ন ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই একজন পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, “দেশই বরঞ্চ তাকে তার মাটির কোলের সাথে আবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি কখনও তার দেশের প্রজাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। কখনও স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেন নি। পলাশী প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে এক মাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক।”
মূলত নবাব সিরাজরা প্রায়শই জন্ম নেয় না। কিন্তু নানা রকমের মীর জাফররা এখন সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই এদের ষড়যন্ত্র থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে শহীদ নবাব সিরাজের চেতনা উজ্জীবিত হতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/334945