ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে বেপরোয়া বাসচালক
২২ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ১১:৪৫

মহাসড়কে ঝরছে প্রাণ

ভয়াবহ রুপ নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। মহাসড়কে প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। অনেকেই হচ্ছেন পঙ্গু। প্রিয়জনের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য সড়কপথে রওনা করে অনেকেই লাশ হয়ে ফিরেছেন। অনেকের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে। এবার ঈদে তিনদিনের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫২ জন। ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতে গিয়েও ঘটছে দুর্ঘটনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা একটার দিকে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় ট্রাকচাপায় আকবর আলী (৭০) নামের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় এক এমপি পুত্রের গাড়িচাপায় মারা গেছে এক পথচারি। শুধু মহাসড়কে নয়, ঈদের ছুটিতে রাজধানীর ফাঁকা রাজপথেও অহরহ দুর্ঘটনা ঘটে। পঙ্গু হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, ঈদের ছুটির সময়ে পঙ্গু হাসপাতালে আসা প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীই সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন। এর বড় একটি অংশই সিএনজি ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। চিকিৎসকরা জানান, ঈদের ছুটিতে ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চলে। তাতে দুর্ঘটনার হার বেড়ে যায়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহতরাই বেশি আসে হাসপাতালে। চিকিৎসকরা বলেন, মোটরসাইকেল চালানো তরুণদের মানসিকতা বদলাতে হবে। অ্যাডভেঞ্চারের মোহে পড়ে তারা এভাবে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে, গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ৪৭ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণ হারানো বা পঙ্গুত্ববরণের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনার ট্রাজেডি সীমাবদ্ধ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫২ শতাংশই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবার নেমে গেছে ছিন্নমূল বা দারিদ্রের কাতারে। বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের সদস্যদের আর কোনো অবলম্বন নেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছোট-বড় ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে সর্বমোট ৭ হাজার ৩৯৭ জন এবং আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৯৩ জন। এর মধ্যে হাত, পা বা অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে ১ হাজার ৭২২ জন। এসব দুর্ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ। এ সময় ১ হাজার ২৪৯টি বাস, ১ হাজার ৬৩৫টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ২৭৬টি হিউম্যান হলার, ২৬২টি কার, জিপ, মাইক্রোবাস, ১ হাজার ৭৪টি অটোরিকশা, ১ হাজার ৪৭৫টি মোটরসাইকেল, ৩২২টি ব্যাটারিচালিত রিকশা, ৮২৪টি নছিমন-করিমন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছিল। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে মোট দুর্ঘটনা ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ, নিহত ২২ দশমিক ২ শতাংশ, আহত ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপদজনক অভারটেকিং, রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ ত্রæটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা।
দুর্ঘটনার জন্য চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে পড়া, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকায় রাস্তার মাঝ পথে পথচারীদের যাতায়াতের কারনেও দুর্ঘটনা ঘটছে।

বেসরকারি সংস্থাগুলো সড়ক দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হলো- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, আনফিট গাড়ি ও থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও সড়কের বেহালদশা। ভুক্তভোগি যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের সময় যাত্রীদের ভিড়ের চাপে মহাসড়কে প্রায় সব গাড়িই বেপরোয়া গতিতে চলে। ট্রিপ বাড়াতে গাড়িগুলো নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করে। আবার একজন চালক বিরামহীনভাবে গাড়ি চালায়। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো দূরপাল্লার গন্তব্যে চলাচল করে। ঈদের আগের দিন বগড়– শহরে দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষণিকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিআরটিসির বাস। এ ছাড়া ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, মিরপুর, নরসিংদী রুটে চলাচলকারী মিনিবাসগুলোকে দেখা গেছে বগুড়া হয়ে রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের পথে যেতে। ঈদের ছুটির তিন দিনে সারাদেশে ঝরে গেছে ৫২টি প্রাণ। আহত হয়েছে দেড় শতাধিক। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে নীলফামারীতে ৯, টাঙ্গাইলে ৫, নারায়ণগঞ্জে ৫, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪, মাগুরায় ৪, চট্টগ্রামে ৩, ঝিনাইদহে ৩, নোয়াখালীতে ৩, সিলেটে ২, ফেনীতে ২, মানিকগঞ্জে ২ জন নিহত হয়েছে। ঈদের পর কর্মস্থলে ফিরতে গিয়েও ঘটছে দুর্ঘটনা। ভুক্তভোগি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঈদে দুর্ঘটনার প্রধান কারন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। ঈদের ছুটিতে যাত্রীদের ভিড়ে প্রতিটি গাড়িই চলেছে বেপরোয়া গতিতে। ভাঙাচোরা সড়কে বেপরোয়া গতিতে চলতে গিয়েই ঘটেছে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কেও বেপরোয়া গতিতে দূরপাল্লার বাস চলাচলের বর্ণনা দিয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বাসটি এক পর্যায়ে রাস্তার উপর বিকল হয়ে পড়ে। এসময় বাসের যান্ত্রাংশ খুলে পড়তে দেখা গেছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গণি মোল্লা বলেন, আগের তুলনায় ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। একবার কেউ হাত-পা হারালে তারা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে যায়। দেশে এখনো কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না। আর কৃত্রিম হাত-পা লাগালেও অনেকে তা ঠিকমতো মেইনটেইন করতে পারে না। এ কারণে পঙ্গুত্বের হার কমাতে সড়ক ব্যবস্থায় উন্নতির বিকল্প নেই।

সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। বেসরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনা ও নিহত আহতের সংখ্যা থাকে বেশি। অপরদিকে, বিআরটিএ বা পুলিশের করা তালিকায় দুর্ঘটনাসহ নিহত আহতের সংখ্যা থাকে কম। বেসরকারি সংস্থাগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তালিকা করে থাকে। আর পুলিশ তালিকা করে মামলার ভিত্তিতে। সেই তালিকাই পুলিশের বরাত দিয়ে প্রকাশ করে বিআরটিএ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বছরের হিসাবে বলা হয়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২১ হাজার ৩১৬ জন। কিন্তু সরকারি হিসাবে ওই বছর নিহত দেখানো হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫৩৮ জন। সংস্থাটি বলছে, দুর্ঘটনার পর মামলার ভিত্তিতে সরকারের এই সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার পর মামলা হয় না। ঘাতক গাড়ির মালিকের সঙ্গে নিহত পরিবার এবং পুলিশের আপসরফার মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, ২০১৪ সালের সারাদেশে ৫ হাজার ৯২৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮ হাজার ৫৮৯জন। অথচ বিআরটিএ’র হিসাবে ওই বছর সারাদেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ২ হাজার ২৭টি। এতে নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭ এবং আহত ১ হাজার ৫৩৫জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৫৮১ দুর্ঘটনায় নিহত ৮ হাজার ৬৪২ এবং আহত ২১ হাজার ৮৫৫জন। অথচ বিআরটিএ’এর হিসাবে ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩৯৪টি দুর্ঘটনায় নিহত ২ হাজার ৩৭৬ এবং আহত ১ হাজার ৯৫৮জন।
চলতি বছরের শুরু থেকেই সারাদেশেই সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে এটি ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। গত ফেব্রæয়ারি দুই দিনে মারা গেছে ৫০জন। এর মধ্যে একটি গ্রামে ফিরেছে ১২টি লাশ। এক সঙ্গে এতো মানুষের প্রাণহানীতে নির্বাক হয়ে পড়েছিল গ্রামবাসী। সড়ক দুর্ঘটনার সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার শতকরা ৬৪ ভাগই সংঘটিত হয় গ্রামাঞ্চলের রাস্তাসমূহে। আর শুধু গ্রামের মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। গবেষণায় বলা হয়, মহাসড়কের মাত্র ৪ ভাগ দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতেই ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত রাস্তার মোড়, পথচারী পারাপারে, বাস স্টপেজে, লেভেল ক্রাসিং, শিক্ষা/ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সিনেমা হল এলাকা, হাটবাজার, রাস্তার বাঁক, সেতু/কালভার্ট এলাকা, মিল/কারখানা এলাকায় ঘটে। এছাড়া, ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ। বুয়েটের গবেষণা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ম ভেঙ্গে ওভারটেক করা এবং নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলারও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল।

https://www.dailyinqilab.com/article/137553