২০ জুন ২০১৮, বুধবার, ১১:৩০

মেয়েদের পড়াশোনা কতটা অবৈতনিক!

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হলেও এই সুবিধা সবাই পাচ্ছে না। এখনও প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে টিউশন ফি দিয়েই প্রথম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হচ্ছে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত টিউশন ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে অন্তত ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীকে। এর বাইরে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা ব্যয় তো আছেই। বিভিন্ন খাতে সন্তানের শিক্ষা ব্যয় বাড়তে থাকায় বিপাকে আছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, আয়ের এক তৃতীয়াংশই খরচ করতে হচ্ছে সন্তানদের পড়াশোনায়। তাছাড়া উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়ার কথা থাকলেও অনেক স্কুলে তারা সে সুযোগ পাচ্ছে না।

অভিভাবকদের প্রশ্ন, ‘মাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক’, ‘ডিগ্রি পর্যন্ত মেয়েদের পড়ার খরচ নেই’ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এমন বক্তব্য প্রচার করা হলেও এ কথা কতটা সত্য? সব মেয়ে বা ছেলে কী বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ পায়?

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক। কিন্তু দেশের সব প্রাথমিক শিক্ষার্থী ‘অবৈতনিক’ সুবিধা পাচ্ছে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ কোটি ৩৯ লাখ শিক্ষার্থী এ সুবিধা পা্চ্ছে। এর বাইরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হাইস্কুল সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনজিও পরিচালিত স্কুল, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্কুল, কেজি স্কুলসহ অন্যান্য প্রাইমারি স্কুলে পড়ছে প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে অন্তত ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে মাস শেষে টিউশন ফি গুণতে হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকই মেয়ে।

ঢাকার রাজধানী মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক সালমা খাতুন বলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানের শিক্ষার জন্য স্কুলের বেতন, কোচিং ফিসহ মাসে গুণতে হচ্ছে ৭-৮ হাজার টাকা। বছরে খরচ ১ লাখ টাকা। আমারা তো প্রাথমিক শিক্ষার অবৈতনিক সুবিধা পাচ্ছি না।

এদিকে, মাধ্যমিক স্তরে পড়ছে ১ কোটি শিক্ষার্থী। এই স্তরে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মেয়ে ও ২০ শতাংশ ছেলে উপবৃত্তির আওতায় শিক্ষা সুবিধা পাচ্ছে। সব মিলিয়ে ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়, যার মধ্যে ২৭ লাখ মেয়ে। উপবৃত্তি না পাওয়া বাকী ৫৫ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেক মেয়ে। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরে আরো প্রায় সাড়ে ২৭ লাখ মেয়ে রয়ে যাচ্ছে যারা বৃত্তির আওতায় আসছে না।

তথ্য অনুযায়ী, সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮৩ উপজেলার প্রায় ১৮ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির তালিকাভূক্ত। সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি এন্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ) এর মাধ্যমে ২৫০টি উপজেলার প্রায় ২৫ লাখ এবং সেসিপ নামে অন্য একটি প্রকল্পের মধ্যে ৫৪টি উপজেলার প্রায় ৪ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির তালিকাভূক্ত হয়েছে। সব মিলে উপবৃত্তির সুবিধা পাচ্ছে ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী।

সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের যে উপবৃত্তি দেয়া হয় শুধু তাদের বিনা টিউশন ফি’তে পড়ার সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু এ নিয়মও মানা হচ্ছে না। উপবৃত্তি পাচ্ছে এমন শিক্ষার্থীকে টিউশন ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে অনেক স্কুলেই। এ ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য টিউশন ফি বাবদ প্রকল্প থেকে শ্রেণি ভেদে ৩০ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়। এর চেয়ে টিউশন ফি বেশি। রংপুরের জেলার একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির টিউশন ফি ১শ’ টাকা। সে স্কুলে প্রকল্প থেকে পাওয়া ৩০ টাকা বাদ দিয়ে ৭০ টাকা আদায় করা হয়। সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রকল্পের পরিচালক শরীফ মোর্তজা মামুন বলেন, উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়ার কথা। কোথাও অনিয়ম হলে স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।

উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ২৫ লাখ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করলেও মাত্র ৬ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে, যাদের বিনা টিউশন ফি’তে পড়ার সুযোগ রয়েছে। উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মেয়ে ও ১০ শতাংশ ছেলে। অর্থাৎ ৪ লাখ ৮০ হাজার মেয়ে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, বইক্রয়, ফরমপূরণসহ অন্যান্য খরচের জন্য বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের বার্ষিক দুই হাজার ৮০০ এবং মানবিক, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দুই হাজার ১০০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেয়া হয়। টিউশন ফি’র জন্য শিক্ষার্থী প্রতি মাত্র ৫০ টাকা দেয়া হচ্ছে প্রকল্প থেকে। কিন্তু বেশিরভাগ কলেজেই টিউশন ফি ৫শ’ টাকার বেশি। এ কারণে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরাও টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করছে।

প্রকল্পের উপ-পরিচালক এস এম সাইফুল আলম বলেন, উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিনা টিউশন ফিতে পড়ার কথা থাকলেও অনেক স্থানে এ শর্ত মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ এসেছে।

ডিগ্রি (পাস) ও সমমানের পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী ১৩ লাখ। এর মধ্যে মোট ২ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে। যার মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার ছাত্রী। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে এ অর্থের যোগান দেয়া হচ্ছে।

এছাড়া স্নাতক (সম্মান), মাস্টার্সে পড়ছে ১৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ২৪ হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে। এর বাইরে প্রাথমিক, ইবতেদায়ী, জেএসসি, জেডিসি থেকে স্নাতক পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষার্থী মেধাবৃত্তি পাচ্ছে।

অভিভাবকরা বলছেন, বই, খাতা, কাগজের দামসহ টিউশন ফি, কোচিং ফি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ভাড়া-সবই প্রতি বছর বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সন্তানের পড়াশোনার খরচ মেটাতে গিয়েই অনেক অভিভাবকের অবস্থাই রীতিমতো করুণ হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বেসরকারি চাকুরিজীবীদের অবস্থা খুবই খারাপ। বাসা ভাড়াসহ সংসারের যাবতীয় ব্যয় বাড়ছে। এরমধ্যে সন্তানদের বাড়তি পড়াশোনার খরচ মেটাতে গিয়ে পরিবারগুলোর অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। ছোটখাট বিরূপ পরিস্থিতি সামলানোর আর্থিক ক্ষমতাও থাকছে না এসব পরিবারের।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য নানামূখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেকে টিউশন ফি ছাড়াই পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।

নারী শিক্ষাকে উত্সাহিত করার উপায় হিসেবে ১৯৮২ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রকল্প চালু হয়, বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক (পাস) পর্যায়ে ৫টি প্রকল্প চালু রয়েছে।

 

 

http://www.ittefaq.com.bd/national/2018/06/20/160869.html