২০ জুন ২০১৮, বুধবার, ১১:২৪

ফাঁকা ঢাকায় ছিনতাই আতঙ্ক

ঈদের ছুটি শেষ হলেও রাজধানী ঢাকা এখনও অনেক ফাঁকা। অফিস আদালত থেকে শুরু করে সর্বত্র বাড়েনি মানুষের কোলাহল। রাস্তাঘাটে নাই তেমন গাড়ি চলাচল। চিরচেনা যানজটের দেখা মেলে না তেমন একটা। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর গুরুত্বপূর্ণ দুই একটি সড়ক ছাড়া প্রতিটি সড়কই জনশূন্য থাকে। আর এ সুযোগেই ছিনতাইকারীরা অনেকটা নরীবেই তাদের মিশন চালাচ্ছে।
ফাঁকা ঢাকায় সক্রিয় হয়েছে একাধিক ছিনতাইকারী চক্র। লুটে নিচ্ছে মানুষের সর্বস্ব। ঈদের আগে থেকেই রাজধানী যখন ফাঁকা হচ্ছিলো তখন থেকেই ছিনতাইকারী চক্র মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ছিনতাইকারী চক্রের কবলে পড়ে সব হারিয়েছেন এমন ভুক্তভোগী প্রায় শতাধিক। তবে এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের ঝামেলা এড়ানোর জন্য থানায় অভিযোগ করছেন না। পুলিশ বলছে, মূলত থানায় অভিযোগ দায়েরের পর তদন্তের স্বার্থে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে তথ্য নেয়ার স্বার্থে যোগাযোগ করা হয়। বেশি যোগাযোগ করলে ভুক্তভোগীরা ঝামেলা মনে করে থানায় অভিযোগ করেন না। শুধুমাত্র ছিনতাইকারীরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে গেলে সাধারণ ডায়েরি করে যান।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা। আরামবাগ দিয়ে কমলাপুরের বাসায় ফিরছিলেন সোবহান মিয়া। হাঁটতে হাঁটতে আরামবাগ মোড়ে আসার পর কয়েক যুবক তার গতিরোধ করে। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগে ছিনতাইকারীর এক সদস্য সোবহান মিয়ার হাত টান দিয়ে তার কোমরে নিয়ে লাগায়। আরেক যুবক তখন বলে এখানে পিস্তল আছে। কোনো সাউন্ড না করে যা আছে দিয়ে দেন। অনেকটা হতভম্ব হয়ে সোবহান মিয়া সঙ্গে থাকা দুটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ১১ হাজার টাকা তুলে দেন তাদের হাতে। সবকিছু নেয়ার পর ছিনতাইকারীরা বলে সোজা চলে যান। পেছনে তাকালেই বিপদ হবে। পরে তিনি সোজা বাসায় চলে যান। গভীর রাত হওয়াতে থানায় আর অভিযোগ করেননি। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে সোবহান মিয়া বলেন, অন্তত ছয় ফুট উচ্চতার চার যুবক। পোশাকে আশাকে বেশ উগ্রতা ছিল। উল্টাপাল্টা কিছু করবে ভেবে ঝামেলা না করে সব কিছু দিয়ে দিই। তিনি বলেন, চাঁদ রাতে আমার এক আত্মীয় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন। পল্টন থেকে শাহজানপুরের বাসায় ফেরার পথে কয়েকজন যুবক অস্ত্র ঠেকিয়ে ঈদের পোশাক, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে।

শুধু তাই নয়, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সব হারিয়েছেন ফটোগ্রাফির কাজে বাংলাদেশে আসা জার্মান তরুণী সুইন্ডে উইদারহোল্ড। নিজ দেশে যাবার আগে তিনি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, একটি ঘটনা পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণে অভিজ্ঞতাটি কালো মেঘে ঢেকে দিল। বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য নিরাপদ নয়। এখানে একা ভ্রমণ না করাই ভালো। সুইন্ডে আরো লিখেছেন, আমি শুধু একটি কথাই বলতে পারি দেখে শুনে চলো, নিজের ক্ষেত্রে সাবধান থেকো। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বাংলাদেশ ছাড়ছি। ধানমন্ডি থানা সূত্রে জানা গেছে, জার্মান থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে আসেন সুইন্ডে উইদারহোল্ড। ফটোগ্রাফির কোর্সে ভর্তি হোন ধানমন্ডির পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটে। ঈদের আগের দিন বাসায় ফেরার জন্য শংকর বাসস্ট্যান্ড থেকে তিনি একটি রিকশা নেন। রিকশা করে জিগাতলা হয়ে সীমান্ত স্কয়ারের সামনে আসার পর একটি সাদা গাড়ি থেকে নেমে এক লোক তার ব্যাগ টান মেরে নিয়ে চলে যায়। ওই ব্যাগে নগদ ৫ হাজার টাকা, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, ক্রেডিটকার্ড ও দুটি হার্ডডিস্কসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। পরে তিনি ধানমন্ডি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ মানবজমিনকে বলেন, ওই দিনের ঘটনায় তদন্ত চলছে। এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আমরা ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছি। জার্মান ওই তরুণীর টাকা পয়সা ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিনতাইকারীরা নিয়ে গেছে। যদিও তিনি এখন তার দেশে চলে গেছেন। তবে আমরা মোবাইল নম্বর ও তার বাংলাদেশে পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। ফাঁকা ঢাকায় ছিনতাই আতঙ্কে আছেন রাজধানীর অনেক এলাকার বাসিন্দারা। ভোরবেলা বা গভীর রাতে কোনো কাজে বের হলে এই আতঙ্কটা বেড়ে যায়। আবার ভয়ঙ্কর ছিনতাইকারীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে ফিল্মি কায়দায় জনবহুল এলাকা থেকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। ঢাকায় ছিনতাইয়ে দুই ধরনের গ্রুপ কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই করে এক ধরনের গ্রুপ। আর মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার থেকে রিকশা ও পায়ে হাঁটা মানুষের কাছ থেকে টান দিয়ে ছিনতাই করে আরেক গ্রুপ। টানপার্টির কবলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে এ ধরনের ঘটনাও এখন অনেক। চলতি বছরের ২৬শে জানুয়ারি ভোরবেলা ধানমন্ডির আনোয়ার খান মেডিকেল হাসপাতালের সামনে টানাপার্টির কবলে পড়ে মৃত্যু হয় ৩৫ বছর বয়সী হেলেনা বেগমের। তিনি গ্রীন লাইফ হাসপাতালের মিডওয়াইকারী ছিলেন। ওই দিন ভোরে তিনি বাড়ি থেতে ফিরে গ্রীন রোডের বাসায় যাচ্ছিলেন। সদরঘাট থেকে একটি বাসে এসে আনোয়ার খান হাসপাতালের সামনে নেমে রিকশার খোঁজ করছিলেন। এ সময় পেছন থেকে আসা একটি প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে ছিনকতাইকারী তার ব্যাগ ধরে টান দেয়। টানাটানির একপর্যায়ে ওই ছিনতাইকারী গাড়ির চাকা দিয়ে হেলেনার মাথা পিষ্ট করে চলে যায়। এর আগে দয়াগঞ্জে টানাপার্টির কবলে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়। তবে এ বছর ঈদে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে হতাহতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও সর্বস্ব খোয়ানোর ঘটনা অনেক। ঈদের দিন আনুমানিক রাত ১০টার দিকে মোহাম্মদ ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন আনোয়ার নামের এক ব্যবসায়ী। জেনেভা ক্যাম্পের আশেপাশে আসার পরই দুজন মধ্য বয়সী লোক তাকে আটকায়। তখন ধারালো ছুরি ঠেকিয়ে তার কাছে থাকা ২৫ হাজার টাকা, মোবাইল ফোন, একটি স্বর্ণের আংটি ও ঘড়ি নিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীরা। কিছুক্ষণ পর পরিচিত লোকদের নিয়ে ঘটনাস্থল ও তার আশেপাশের অনেক অলিগলিতে খোঁজাখুঁজি করে ওই দুই ছিনতাইকারীকে আর খোঁজে পাওয়া যায়নি। সূত্র বলছে, ঈদের আগ থেকেই সক্রিয় হয়েছে একাধিক ছিনতাইকারী চক্র। নিয়মিতদের পাশাপাশি যোগ হয়েছে মৌসুমি ছিনতাইকারীরা। সব মিলিয়ে অন্তত শতাধিক চক্র রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের সঙ্গে রয়েছে টানাপার্টি। এলাকাভিত্তিক তাদের আলাদা আলাদা নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ছিনতাইকারীদের আটক করে শাস্তির আওতায় আনলেও জামিনে বের হয়ে ফের তারা একই কাজ করে। আর পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছেন, আগের তুলনায় এখন অনেকটাই কমেছে ছিনতাই। বিশেষ পুলিশি ও গোয়েন্দা অভিযানের পর অনেক ছিনতাইকারীকে জেলে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া নিয়মিত অভিযান চলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে অপরাধীরা সক্রিয় থাকে। সেজন্য পুলিশও তাদের প্রতিহত করার জন্য সজাগ থাকে। রমজানের শুরু থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য প্রতিটি থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে রাজধানীকে ঘিরে নানা অপরাধ চক্রকে ধরতে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন করা ছিল। আর ছিনতাইকারীসহ অন্য অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পয়েন্টে পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। তিনি বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত যতগুলি অভিযোগ পুলিশের কাছে এসেছে তার প্রত্যকটিই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জনগণ নির্বিঘ্নে চলার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা পুলিশ করছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=122063