২০ জুন ২০১৮, বুধবার, ১১:১৯

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার আয় স্থগিত

কমে যাচ্ছে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা মন্দা, বিনিয়োগ স্থবিরতায় অনেক ব্যবসায়ী প্রকৃতপক্ষেই ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে বলা চলে খেলাপি ঋণ বেড়ে মার্চ শেষে তা পাহাড় সমান হয়ে গেছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণও বেড়ে গেছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাতে অস্বাভাবিক হারে আয় কমে যাচ্ছে। শুধু মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার। আদায় অযোগ্য ঋণ অর্থাৎ মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সামনে আদায় অযোগ্য ঋণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ী নানা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন; কিন্তু পরিশোধ করছেন না। একপর্যায়ে তারা ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। যেসব ঋণ ব্যাংকের খাতায় খেলাপি দেখানো হচ্ছে না তার বড় একটি অংশ বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করে নেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি যেসব ঋণ নবায়ন হয়নি ওইসব ঋণও আদায় অযোগ্য অর্থাৎ কুঋণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। তবে অবলোপন হওয়া প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হবে প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, মন্দ ঋণের বিপরীতে ধার্যকৃত মুনাফা বা সুদ ব্যাংকগুলো আয় হিসেবে দেখাতে পারে না। এসব সুদ বা মুনাফা ব্যাংকের আয় খাত থেকে আলাদা করে রাখা হয়। অপর দিকে, মন্দ ঋণ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসেবে ধরা হয়। আর এ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন হলো আমানতকারীদের আমানত সুক্ষা করতে সংরক্ষিত অর্থ। একে নিরাপত্তা সঞ্চিতিও বলা হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জরিমানা বা তিরস্কার গুনতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিরস্কার বা জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে অর্থাৎ মুনাফা থেকে প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করে থাকে। এর ফলে এক দিকে ব্যাংকগুলোর মুনাফার পরিমাণ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররাও বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিপরীতে টাকা আটকে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কারণ ঋণ আদায় হলে ওই ঋণ আবার ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারে; কিন্তু ঋণ আদায় না হলে ব্যাংকগুলো ওই অর্থ আর পুনঃবিনিয়োগ করতে পারে না। এভাবে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যায়। আবার এ মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ স্থগিত করায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ৩১ মার্চ ভিত্তিক খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৫৮টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ স্থগিত করা হয়েছে সরকারি মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের। ব্যাংক ছয়টিতে ১১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে। এ ব্যাংক চারটির মার্চ শেষে ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩৭ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকাই কুঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণ।

আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ২৯ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। এ মন্দ ঋণের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মার্চ শেষে সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপনসহ মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশির ভাগই আদায় অযোগ্য বা কুঋণে পরিণত হয়েছে। এসব ঋণ আদায়ে মামলাও করা হয়েছে; কিন্তু অর্থঋণ আদালতে পর্যাপ্তসংখ্যক বেঞ্চ এবং বিচারক না থাকায় মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আবার সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশের হাইকোর্ট ডিভিশনে অর্থঋণ আদালতের জন্য পৃথক কোনো বেঞ্চ নেই। সব মিলে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবলোপনকৃত ঋণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু খেলাপি গ্রাহক আংশিক ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট অংশ বিশেষ করে সুদ ও আসলের একটি অংশ মওকুফের আবেদন করছে। তবে আসল মওকুফের সুযোগ না থাকায় এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি বিক্রয় বা ব্যাংকের অনুকূলে মিউটেশন করা যাচ্ছে না। সব মিলেই শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, একজন ঋণখেলাপি অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন না। এমনকি জাতীয় কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের সবচেয়ে বড় জটিলতা দেখা দিয়েছে আইনগত জটিলতা। শ্রেণীকৃত ঋণ আদায়ে আইনি জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। খেলাপি গ্রাহকেরা ঋণ পরিশোধ না করার জন্য বিভিন্ন আইনি ফাঁকফোকর বের করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি গ্রাহকেরা শ্রেণীকরণ হতে বেরিয়ে আসার জন্য মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে শ্রেণীকরণের ওপর স্থাগিতাদেশ নিচ্ছেন। এ সুবাদে তারা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণসুবিধা নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আইনগত বাধা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো প্রকৃতপক্ষে একজন ঋণখেলাপিকেই গ্রাহক হিসেবে গ্রহণ করছে। ওই গ্রাহক পুনরায় খেলাপি হয়ে আবার আদালতে মামলা দায়ের করছেন। এভাবে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে তারা আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করছেন। এতে ব্যাংকগুলোর জন্য অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দেখা দিচ্ছে। একই সাথে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/326345