২০ জুন ২০১৮, বুধবার, ১১:১২

আমদানির আড়ালে মুদ্রা পাচার বাড়ছেই

আমদানি ব্যয় বাড়ছে লাগামহীন। সেই তুলনায় বাড়ছে না রফতানি আয়। ফলে বেড়েই চলেছে বাণিজ্য ঘাটতি। এতে করে আমদানির নামে মুদ্রা পাচারের অভিযোগ আরও ঘনিভূত হচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে ডলারের দামও। অস্থিতিশীল হচ্ছে দেশের মুদ্রা বাজারও। অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ আমদানির আড়ালে মুদ্রা পাচার বাড়ছেই। আর এ কারণেই দেশে দৃশ্যমান কোন বিনিয়োগ নেই।
চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এ ঘাটতি পৌঁছেছে এক হাজার ৫৩৩ কোটি ডলারে। ঘাটতির এ অংক গত বছরের একই সময়ের প্রায় দ্বিগুণ। কেন্দ্রীয় ব্র্যাংক যদি কঠোর ভুমিকা রাখতে না পারে তাহলে মুদ্রা বাজারে আরও অস্থিরতা বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা চাপে পড়েছে। আমদনির বাড়লেই বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে আমদানি ও শিল্প পণ্যের দামে। এতে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। চাপ সৃষ্টি হচ্ছে মূল্যস্ফীতির ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের দশম মাস এপ্রিল শেষে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারে, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮১৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যতটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। দেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। এসব বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি বেড়ে গেছে। এ ছাড়াও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে।

এসব কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। তবে এ ঘাটতি মেটানো হয় রেমিট্যান্স ও বিদেশী বিনিয়োগ দিয়ে। এ খাতেও নিম্নগতি ছিল বেশকিছু দিন। ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট বা বিওপি) ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ভালো নয় বলে মনে করছেন তারা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিল শেষে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে আয় হয়েছে তিন হাজার এক কোটি ১০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে চার হাজার ৫৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতির দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যা বর্তমান বিনিময় হার (৮৪ টাকা) অনুযায়ী এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আলোচিত সময়ে, আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর বিপরীতে রফতানি বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্তের ধারা অব্যাহত থাকলেও গত অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। এপ্রিলেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। এতে বৈদেশিক দায় পরিশোধে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১৪৮ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে ৮৫১ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল ১৭৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
আলোচিত সময়ে সেবাখাতে বিদেশীদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়েছে ৭৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আর এ খাতে আয় হয়েছে মাত্র ৩৬২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে দশ মাসে সেবায় বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৭৭ কোটি ডলারে। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল (ঘাটতি) ২৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এপ্রিল শেষে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে মোট ২৩৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৫৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগও সামান্য বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের আলোচিত মাসে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
জানা গেছে আমদানির নামে ডলারের দাম বাড়লেও আড়ালে কি হচ্ছে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছেন, আমদানি বাড়লে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় আর বিনিয়োগ বাড়লে দেশের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা কিন্তু তা হচ্ছে না। এতে করে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় দেশ থেকে মুদ্রা পাচার হচ্ছে।

সংস্থাটির অভিযোগ নির্বাচনের বছর এলেই মুদ্রা পাচার বেড়ে যায়। এ বছর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে আমদানি বেড়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দৃম্যমান কোন তথ্য নেই। সরকার যদি মুদ্রা পাচার রোধ করতে না পারে তাহলে ডলারের দাম আরও বাড়বে। যা সরকারের বিপাকে ফেলতে পারে।
টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বাড়ছে নিয়মিতই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩ টাকা ১৬ পয়সা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, সর্বশেষ গত এক মাসে ডলারের দাম ৭২ পয়সা বেড়েছে।
বাজারের বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। বেশ কিছু ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হারের চেয়ে বাড়তি মূল্য আদায় করছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর সাধারণ মানুষ, যাঁরা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬ টাকার কাছাকাছি দরে।

ডলারের দামের এই তেজিভাবে কিছুটা উৎসাহিত হচ্ছে রপ্তানি খাত। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণও বেড়েছে। তবে এতে বেড়ে যাচ্ছে পণ্য আমদানির ব্যয়। কারণ, আমদানির জন্য বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামালসহ সব আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়ছে। এতে নির্বাচনের বছরে মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ডলারের দাম বাড়ার মূল কারণ রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেড়ে যাওয়া। দেশে চাল, গম ও অন্যান্য পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের চাহিদা। মূলধনি যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্র, উন্নয়ন প্রকল্পের উপকরণ আমদানি ইত্যাদি কারণে সার্বিক আমদানির চাপ বেড়েছে।

এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। এতে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। নতুন করে আমদানি শুরু হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। ভবিষ্যতে কয়লা আমদানিও বিপুলভাবে বাড়বে। বিশ্ববাজারে পোশাকশিল্পের কাঁচামাল তুলার দাম অনেক বেড়ে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে খরচ কমার আশা নেই। কারণ, বিভিন্ন পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ফলে আগামী দিনগুলোতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে ডলারের দামে স্বস্তি ফেরার আশাও কম।
সার্বিক পরিস্থিতিতে কপালে ভাঁজ পড়ছে ব্যবসায়ীদের। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। ডলারের দাম বাড়লে ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়। পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, আপনি যদি জ্বালানির জন্য ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর হন, তাহলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমন চাপ তৈরি হবেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৬ সালের মে মাসে ডলারের দাম ছিল ৭৮ টাকার ৪০ পয়সা। ২০১৭ সালের একই মাসে তা দাঁড়ায় ৮০ টাকা ৫০ পয়সার মতো। চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৮৩ টাকা ছাড়ায়।
অবশ্য সাধারণ মানুষ এ দরে ডলার কিনতে পারবেন না। বাজার থেকে ডলার কিনতে তাঁদের ব্যয় হচ্ছে প্রতি ডলারে ৮৬ টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানিতে ডলারের যে দাম নেওয়ার কথা ব্যাংকগুলোর, তা অনেকে মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দর মেনে ডলার বিক্রি করলেও ‘হ্যান্ডলিং চার্জের’ নামে আলাদা বিল ধরিয়ে দিচ্ছে।

আমদানি চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ২১৪ কোটি ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলো কাছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা দামে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে। এ দামেই ঋণপত্রের দেনা শোধ করতে হচ্ছে। সরকারি ঋণপত্রের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার দিলেও বেসরকারি খাতের জন্য ডলার দিচ্ছে না। ফলে বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে, এতে প্রতি ডলার ৮৫ টাকার বেশি পড়ে যাচ্ছে।
রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ছয় মাস আগে ঋণপত্র খোলার সময় কয়েকটি ব্যাংক তখনকার দাম স্থায়ী ধরেই গ্রাহকদের সঙ্গে ঋণপত্র নিষ্পত্তির চুক্তি করেছিল। এ সময়ে প্রতি ডলারের দাম ২ টাকা বাড়ায় এসব ব্যাংক এখন লোকসান গুণছে।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, কয়েকটি ব্যাংক না বুঝেই ঋণপত্র খুলেছে। আমদানি দায় শোধ করতে গিয়ে তারা ডলারের দাম বাড়িয়ে ফেলছে। ফলে গ্রাহকদের অনেকেই এখন ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো অনেক সতর্ক হয়ে গেছে।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার সংকট কাটাতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানো ও বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, ডলার সংকট চলতে থাকলে সবার ওপরই চাপ বাড়বে।

http://www.dailysangram.com/post/334633