২০ জুন ২০১৮, বুধবার, ১১:১২

ঋণের ভারে জর্জরিত জাতীয় বাজেট

ঋণের ভারে জর্জরিত চলতি জাতীয় বাজেট। বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। বাড়ছে সরকারের ব্যয়। কিন্তু ব্যয় অনুযায়ী আয় হচ্ছে না। ফলে দেয়া হচ্ছে ঘাটতি বাজেট। আর এ ঘাটতি মেটাতে নিতে হচ্ছে ঋণ। এতে প্রতি বছরই ঋণ বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ঋণের সুদ। সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে ঋণ নিয়ে। চলতি অর্থ বছরে সুদের বোঝা টানতে হবে সাড়ে ৫১ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় বেশির ভাগ অর্থাৎ ৫১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকাই বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধের জন্য, যা অনুন্নয়ন বাজেটের একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ। আর সামগ্রিক বাজেটের ১১ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বর্তমান সরকারের ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকাই চলে যাবে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে। সরকারের এই বিশাল অঙ্কের সুদ পরিশোধের জন্য সঞ্চয়পত্রের দায়ের কথা বলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ০১ শতাংশই খরচ হবে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ মেটাতে ব্যয় হবে ৪৮ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। আর বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে চলে যাবে ২ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছিল ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছেন অর্থমন্ত্রী।

বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে এ সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। অথচ নীতি পরিবর্তন করলে অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন করা যেত। এটা অব্যাহত থাকলে সামনে সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা ও সুদ পরিশোধেই বাজেটের সমুদয় অর্থ ব্যয় করতে হবে। সঙ্কুচিত হয়ে যাবে উন্নয়ন বাজেট।
আগামী অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকার সামগ্রিক বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। এ অনুন্নয়ন বাজেটের মধ্যে শুধু ঋণের সুদ ও সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা এবং পেনশন পরিশোধেই ব্যয় হবে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ৫১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের বাজেটে ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় বাড়ছে প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ।
এই ঋণের বোঝা কমাতে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেশি হয়েছে। ফলে সরকারের ঋণের বোঝাও বেড়েছে। সে বোঝার সুদই এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে বাজেটের মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে।

অর্থনীতিবীদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ার কারণেই বিক্রি বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার যেখানে সিঙ্গেল ডিজিটে ছিল, সেখানে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ডাবল ডিজিটে (১০ শতাংশের উপরে)। আর সে কারণেই সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ এই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকেছে মানুষ। যার সঞ্চয় ছিল সে-ই সঞ্চয়পত্র কিনেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৭৫ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্তির কারণে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ২২ হাজার ৭১৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর সুদ বা মুনাফা শোধ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৮১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ৬০ হাজার ১২৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। মেয়াদ পূর্তির পর গ্রাহকরা আসল তুলে নিয়েছেন ৮ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার জুলাই মাসে পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বলেছি, সঞ্চয়পত্রে যে মুনাফা পাওয়া যায় সেটা নিয়ে সভা দিয়েছিলাম, সভা করতে পারিনি। সবশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেনি। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দুই-তিন বছর পর পর পর্যালোচনা করার কথা জানিয়ে মুহিত বলেন, এবার একটু দেরি হয়েছে, পরের মাসে রিভিউ হবে।

সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে বলে গত বছরও (২০১৭ সালের মে মাসে) বাজেটের আগে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু পরে বাজেট অধিবেশনে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করায় শেষ পর্যন্ত আর সুদের হার কমানো হয়নি। তবে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল, সরকার তার চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে এপ্রিল মাসের মধ্যেই। এ পরিস্থিতিতে গত মে মাসে বাজেটপূর্ব এক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বাজেটের পর সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সমন্বয় করার কথা বলেছিলেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে। এর মধ্যে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা ঠিক করেছেন মুহিত।

বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, প্রতি বছরই সরকার বাজেটের আকার বাড়াচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী আয় বাড়াতে পাড়ছে না। এ কারণে ঋণনির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে বাজেট বাস্তবায়নে। ঋণনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সুদ ব্যয়। যেমন, গত ৫ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বেড়েছে প্রায় শতভাগের বেশি। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে সুদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ৫ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। অস্বাভাবিক হারে ঋণের সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, সরকারের ভুল নীতির কারণে প্রতি বছরই ঋণের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, সরকার ইচ্ছে করলেই কম সুদে ঋণ নিতে পারে। কিন্তু সে পথে সরকার হাঁটছে না।
এ কারণে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। আবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও তুলনামূলকভাবে কম হারে ঋণ নিতে পারে। সরকার ইচ্ছে করলেই এখন সিঙ্গেল ডিজিটে অর্থাৎ স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। এতে ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় কমে যেত। কিন্তু সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না। ঋণ নিচ্ছে ব্যাংকবহির্ভূত খাত অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের সুদ এখনো সাড়ে ১১ শতাংশ রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী সরকার এ খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে ব্যাংক থেকে আর ঋণ নিতে হচ্ছে না। বরং উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের কম সুদের ঋণ পরিশোধ করছে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সরকারের এ ভুল নীতির কারণেই সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/334630