প্রতীকী ছবি
১৪ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:৪১

ঈদকে টার্গেট করে রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র

গুলি করে কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ * র‌্যাবের মাইক্রোবাসে হামলা * ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা * ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে না : ডিএমপি কমিশনার

ঈদকে টার্গেট করে রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্র। তারা একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। ছিনতাইকালে তারা গুলি করে মানুষ হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না।
তাদের ছুরিকাঘাতে আহত হচ্ছেন অনেকে। রাজধানীজুড়ে পুলিশের টহল টিম থাকলেও ছিনতাইয়ের ঘটনার সময় পুলিশের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনতার হাতে ছিনতাইকারীরা আটক হচ্ছে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিনতাইকারী ধরতে গিয়ে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। ছিনতাইকারীরা এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে, তারা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাও করছে। আক্রমণ করছে র্যা বের মাইক্রোবাসে।
র্যা ব, পুলিশ এবং ভুক্তভোগীরা যুগান্তরকে এসব তথ্য দিয়েছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছেন, ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। এখন ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটছে না।
১০ জুন দুপুরে রাজধানীর ডেমরায় স্থানীয় বিকাশ এজেন্ট ওয়ানজা ডিস্ট্রিবিউশনের কর্মী রাশেদুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ওই ব্যাগে ৭২ হাজার টাকা ছিল।
ছিনতাইকারীরা প্রথমে রাশেদুলের বাম হাতে গুলি করে। পরে মুখে আরও দুটি গুলি করে। এর আগেরদিন রাতে সবুজবাগ মাদারটেক এলাকায় রাহাত মিয়া নামে এক যুবক ছিনতাইকারীর ছরিকাঘাতে নিহত হন। ওইদিন রাত ১১টার দিকে জুয়েলারি দোকানের মালিক হাবিব পাঠান তার দোকান বন্ধ করে আড়াই লাখ টাকা মূল্যমানের জুয়েলারি সামগ্রী কাপড়ের ব্যাগে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন।
বাসার কাছে পৌঁছলে এক দুর্বৃত্ত তার ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়। হাবিব চিৎকার করে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করলে স্থানীয় রাহাতসহ কয়েকজন মিলে ছিনতাইকারীকে আটকের চেষ্টা করে। এ সময় ছিনতাইকারী রাহাতের পেটে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।

সবুজবাগ থানাধীন রাজারবাগের বাসিন্দা সোহাগ খান বলেন, ৬ জুন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আমি সবুজবাগের কদমতলা হক সোসাইটির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এ সময় কয়েকজন ছিনতাইকারী আমাকে ঘিরে ধরে চাকুর ভয় দেখিয়ে পকেট থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
আমার ডাক-চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছিনতাইকারী সুমন হোসেন শাহীন, নাসিম, মিজানুর রহমান আশিক এবং নাজমুল আলম বিপ্লবকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
বৈশাখী টিভির রিপোর্টার কাজী ফরিদ আহমেদ বলেন, ৯ জুন রাত ১১টার দিকে খামারবাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে ধানমণ্ডি আবহানী মাঠে যাচ্ছিলাম। রিকশাটি সেচ ভবনের পাশে গেলে ছিনতাইকারীরা খুরের ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে স্যামসাং গ্যালক্সি মোবাইল ফোন এবং মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।
রাজধানীর পলওয়েল মার্কেটের দোকান মালিক গাজীউর রহমান জানান, ৭ জুন দুপুরে আমার ম্যানেজার নেয়ামুল দোকান থেকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা নিয়ে বের হন। উদ্দেশ্য ছিল ফকিরাপুল সোনালী ব্যাংক। তিনি রিকশায় টিএন্ডটি কলোনি মসজিদ গেট সংলগ্ন মিতালী রেন্ট-এ কারের সামনে পৌঁছলে ৫-৬ জন ছিনতাইকারী নেয়ামুলের গতিরোধ করে।

ছিনতাইকারীরা চাকুর ভয় দেখিয়ে নেয়ামুলের কাছ থেকে টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ম্যানেজারের ডাক-চিৎকার শুনে লোকজন এগিয়ে এসে সুজিত হালদার এবং রতন মাঝি নামে দুই ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
র্যা ব-১০ এর অধিনায়ক কাইয়ুমুজ্জামান খান জানান, ৪ জুন যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর অভিমুখে রাস্তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করি। র্যা বের একটি দল মাইক্রোবাসে সাদা পোশাকে বেলা আড়াইটার দিকে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল সাদ্দাম মার্কেট ও ট্রাস্ট ব্যাংকের উত্তর পাশে পৌঁছলে একটি খালি পিকআপ র্যােবের মাইক্রোবাসের গতিরোধ করে। পরে পিকআপ থেকে ৬-৭ জন ছিনতাইকারী ছোরা, চাপাতি ও কিরিচ হাতে করে আচমকা র্যা বের মাইক্রোবাস দুই পাশ থেকে ঘেরাও করে। র্যা ব সদস্যরা আত্মরক্ষার সব প্রস্তুতি নিয়ে মাইক্রোবাস থেকে নামে।

এ সময় ছিনতাইকারীদের সঙ্গে র্যা বের ধস্তাধস্তি হয়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ছিনতাইকারী রুবেল শেখ, পারভেজ আজাদ হোসেন এবং অজয়কে গ্রেফতার করা হয়। পালিয়ে যায় ৩-৪ জন ছিনতাইকারী।
র্যা বের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানায়, তাদের কাছে তথ্য ছিল কোনো একটি গার্মেন্টে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য মতিঝিলের আরব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫০-৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করে নারায়ণগঞ্জ ঝালকুড়ির দিকে একটি মাইক্রোবাস যাবে। গাড়ির রং ও বর্ণনা মিলে যাওয়ায় তারা ভুলক্রমে র্যা বের মাইক্রোবাস টার্গেট করে।
দিলকুশা আলামিন সেন্টারের বিকাশ অ্যাকাউন্স অফিসার আশিকুর রহমান বলেন, ৩১ মে আমার সহকর্মী সেলস অফিসার আবদুস সাত্তার মতিঝিল কলোনি হাসপাতাল এলাকায় টাকা লোড দিয়ে অফিসে ফিরছিলেন।

তিনি পাকা রাস্তায় পৌঁছামাত্র ২-৩ জন ছিনতাইকারী কোমর থেকে চাকু বের করে ভয় দেখিয়ে সাত্তারের কাছ থেকে একটি কালো রঙের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। ব্যাগে ৪ লাখ ৪ হাজার ২০০ টাকা ছিল। সাত্তার ব্যাগটি দিতে না চাইলে তার হাতে আঘাত করে রগ কেটে দেয় ছিনতাইকারীরা। সাত্তারের ডাক-চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে সোহাগ নামের এক ছিনতাইকারীকে আটক করে। পাশাপাশি ছিনতাই হওয়া ব্যাগটি তার কাছ থেকে উদ্ধার করে।
মানিকগঞ্জ সিংগাইর থানার আলীনগর গ্রামের লিয়াকত হোসেন জানান, ২৯ মে সকালে ফকিরাপুল আকাশ ভ্রমণ ট্রাভেল এজেন্সিতে টাকা জমা দিতে যাই। এজেন্সি বন্ধ পাওয়ায় হোটেল নুরানীর উদ্দেশে রওনা হই।

সোয়া ৯টার দিকে হোটেলের সামনের রাস্তায় পৌঁছামাত্র ৩-৪ জন ছিনতাইকারী চাকুর ভয় দেখিয়ে আমার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। ওই ব্যাগে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ছিল। আমি চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে ইউসুফ মিয়া নামে এক ছিনতাইকারীকে আটক করে।
ওয়ারী বিবিসি রোডের আজাদ ইলেকট্রনিক হাউসের ম্যানেজার আবদুল আওয়াল গাজী বলেন, ২৯ মে দুপুরে আমি প্রতিষ্ঠানের ৩০ হাজার ৫০০ টাকা মতিঝিলের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য রওনা হই।
বেলা দেড়টার দিকে বঙ্গভবন রোডে শেরেবাংলা স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছলে দুইজন ছিনতাইকারী আমার গতিরোধ করে। তারা চাকু দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমার পায়জামার পকেট থেকে সাড়ে ৩০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।
আমি ডাক-চিৎকার শুরু করলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে ছিনতাইকারীরা দৌড়াতে থাকে। আমিও দৌড়াতে দৌড়াতে ভগবতী ব্যানার্জি রোডে গিয়ে এক ছিনতাইকারীকে ঝাপটে ধরি। এ সময় জনতা তাকে গণধোলাই দেয়।

২২ মে ঢাকা রেলওয়ে থানায় দায়ের করা এক মামলায় রেলওয়ে থানার এসআই নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ২১ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ছিনতাইয়ের সময় আমি ও আমার সঙ্গী ফোর্স মিলে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে পাঁচজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করি।
তাদের বিমানবন্দর রেলওয়ে ফাঁড়িতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইব্রাহিমসহ ৮-১০ জন ছিনতাইকারী জোর করে ফাঁড়িতে প্রবেশ করে। তারা ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে গ্রেফতারকৃত আসামিদের ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আমিসহ পুলিশের অন্য সদস্যরা বাধা দিলে ছিনতাইকারী ইব্রাহিম আমাকে কিল-ঘুষি মেরে জখম করে। এ সময় ফাঁড়ির অন্য পুলিশ সদস্যরা ইব্রাহিমকে আটক করে। অন্য ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়।

এদিকে মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালীতে আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এক সভায় ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাই ঢাকায় কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে না। তবে দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/59819