১৩ জুন ২০১৮, বুধবার, ২:৩২

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গণশুনানী লোক দেখানো মাত্র

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম এক সময় বিদ্যুৎ সচিব ছিলেন। গত বছরের শুরুতে অবসরে যাওয়ার পর তাকে বিইআরসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিদ্যুৎ সচিব থাকাকালে তিনি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব তার হাত দিয়েই হয়েছে। অথচ এখন তাকে দিয়েই গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে গণশুনানী হচ্ছে। যেহেতু তিনি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পক্ষে ছিলেন অতএব তাকে দিয়ে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে না বলে মন্তব্য করেন অনেকে।

গ্যাস বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা কমিশনের সদস্যদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বিইআরসির বর্তমান চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ সচিবের দায়িত্বে যখন ছিলেন, তখন তিনি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে ছিলেন। কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান পিডিবির পরিচালক ছিলেন। তিনি পিডিবির পক্ষে সরাসরি কমিশনের গণশুনানিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিতেন। কমিশনের আরেক সদস্য আবদুল আজিজ খান তিতাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর বিরুদ্ধে তিতাসে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চলছে। তিতাসের সাবেক এমডি হিসেবে তিনিও তিতাসের পক্ষে কথা বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। ফলে গণশুনানী লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য তাদের।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানিতে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে কমিশনের গঠিত সাত সদস্যের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে গ্যাসের গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ১৪৩ ভাগ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করে। তবে গৃহস্থালি এবং বাণিজ্যিক ভোক্তাদের ক্ষেত্রে এবার গ্যাসের দাম বাড়ছে না। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস কোম্পানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল ২৪০ শতাংশ।
শুনানিতে জানানো হয়, তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গড়ে শুধুমাত্র গ্যাসের দাম ৭৫ ভাগ বাড়ানোর জন্য গত ২০ মার্চ কমিশনের কাছে একটি আবেদন করে। এর সঙ্গে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল, সঞ্চালন ব্যয় ও বিতরণ ব্যয় ধরে এই দাম বাড়ানোর হার নির্ধারণ করেছে কমিশনের কারিগরি কমিটি।

কমিশন বলছে, এখন নির্দিষ্ট শ্রেণির গ্রাহকরা গড়ে ৩ দশমিক ৪৪৯৩ টাকায় প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনে থাকে। সব ধরনের তহবিল এবং চার্জ ধরে এই গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারে ১১ দশমিক ৭৪৪৩ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তিতাস। কারিগরি কমিটি মনে করে, এই দর ৮ দশমিক ৪০৫২ টাকা রাখলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিতাসের কোনও লোকসান হবে না।
কেবল এলএনজি আমদানির কারণেই দেশে গ্যাসের দাম বাড়াতে হচ্ছে বলে কারিগরি কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। এখন দেশে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম এক দশমিক ৫৭৮৭ টাকা। আর দৈনিক গড়ে উৎপাদিত দুই হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সঙ্গে প্রতিদিন আমদানি করা এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির ফলে মিশ্রিত গ্যাসের দাম বাড়ছে। তিতাস তার প্রস্তাবে অন্যসব তহবিল এবং চার্জ ব্যতিরেকেই শুধু গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার এক দশমিক ৫৭৮৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৩৭ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কারিগরি কমিটি বলছে এই দাম বৃদ্ধি করা যেতে পারে ৬ দশমিক ৮২ টাকা। তাতেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরিমাণও দাঁড়াবে ৩২২ ভাগ। শুনানিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘তিতাস প্রতিবছর লাভ হোক না হোক, ২৫০ কোটি টাকা সরকার এবং শেয়ার মালিকদের দিচ্ছে। এজন্য তাদের অতিরিক্ত অর্থ তুলতে হচ্ছে।’ তিনি বাপেক্সকে দেওয়া তিতাসের তহবিলের দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এই ঋণের টাকার মধ্যে ২৩০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে তছরুপ হয়েছে।’ সাবেক জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিনের বাজে সিদ্ধান্তের কারণে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিতাস এই টাকা ফেরত পাবে কিনা জানতে চাইলে তিতাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বাপেক্সকে এই অর্থ দিয়েছে। বাপেক্স তাদের অর্থ ফেরত দেবে।

শুনানিতে ঢাবির অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘গত ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে একটি সংকট তৈরি করা হয়েছে। আর এখন সেই সংকটের মাসুল দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে।’ তিনি বলেন, ‘গড়ে প্রতিবছর একটি কূপও খনন করা হয়নি। সিলেট ছাড়া অন্য কোনও এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে খুব একটা কাজ না হওয়ায় এখন এলএনজি আনতে হচ্ছে, যা দেশের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।’

শুনানিতে বুয়েটের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এলএনজি আসছে এই খবরেই গৃহস্থালির গ্রাহকদের ডিমান্ড নোট ইস্যু করা হচ্ছে। আবার একটি মহল এ বিষয়ে তৎপর হয়েছে।’
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান বলেন, ‘নতুন করে কাউকে ডিমান্ড নোট দেওয়া হয়নি। আগে যাদের ডিমান্ট নোট ইস্যু করা হয়েছে, গৃহস্থালিতে সংযোগ দিলে তাদেরই আগে দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে। এখনও গৃহস্থালিতে গ্যাস দেওয়ার বিষয়ে সরকারের কোনও নির্দেশনা পায়নি তিতাস। শুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষে বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিদিন ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়। অন্যদিকে বেশি দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে। চুরির গ্যাস বন্ধ করা গেলে এলএনজি আমদানি করতে হবে না। আর এলএনজি না এলে গ্যাসের দাম বাড়ানোরও প্রয়োজন পড়বে না।

কমিশন বলছে, এখন নির্দিষ্ট শ্রেণির এসব গ্রাহক গড়ে ৩ দশমিক ৪৪৯৩ টাকায় প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনে থাকে। সব ধরনের তহবিল এবং চার্জ ধরে এই গ্যাসের ঘনমিটারপ্রতি ১১ দশমিক ৭৪৪৩ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে তিতাস। কারিগরি কমিটি মনে করছে, এই দর ৮ দশমিক ৪০৫২ টাকা রাখলেই তিতাসের কোনো লোকসান হবে না। শুনানিতে অংশ নেওয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রতিনিধিরা জানান, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বছরে আট হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে। এই বিশাল পরিমাণ অর্থের জোগান ঠিক রাখতে বাড়াতে হবে বিদ্যুতের দাম।
গণশুনানিতে বলা হয় , গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নেই। গ্যাস খাতের অনিয়ম দুর্নীতির কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংক লুটের মতো গ্যাস খাতেও লুটপাট হয়েছে।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাস-সংযোগ সরকার বন্ধ করে রেখেছে নির্বাহী আদেশে। তবে শিল্প-কারখানায় গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার জন্য জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীকে প্রধান করে গ্যাস-সংযোগ কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি কয়েক হাজার শিল্পে সংযোগ দিয়েছে। এ কারণেই এখন গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এই বেআইনি কমিটি গ্যাস খাতকে ‘বটমলেস বাস্কেট’ (তলাবিহীন ঝুড়ি) বানিয়ে ফেলেছে। তিনি বলেন, তিতাস আটটি প্রকল্পে ২ শতাংশ হারে ২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে তিতাস মগনমাতে বিদেশি কোম্পানি সান্তোসের সঙ্গে বাপেক্সকে যৌথভাবে কূপ খনন করার জন্য ১৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ সেখানে কোনো গ্যাস পাওয়া যাবে না সেটা আগেই জানা ছিল। ফলে এই ১৩০ কোটি টাকা 

তিতাস ফিরে পাবে কি না সন্দেহ। বিইআরসির অনুমতি না নিয়ে তিতাসের ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এটি অনিয়ম। http://www.dailysangram.com/post/334150