১২ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ২:১১

টান পড়েছে টাকায়

ঋণ খেলাপি ও তারল্য সঙ্কটে জর্জরিত ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সঙ্কট চলছে। বিশেষ করে ঈদে নগদ টাকার সংস্থান করতে গিয়ে হিমসীম খাচ্ছে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক। বেতন ও ঈদ বোনাস প্রদান করতে গিয়ে শ্রমিক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিপাকে পড়ছে। কিছু গার্মেন্টস আগে থেকে বেতন-বোনাস দিলেও অনেক কারখানাই এখনও দিতে পারেনি। ব্যাংকে চাহিদা মোতাবেক টাকা না পাওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে বিপাকে আছে গার্মেন্টসসহ শ্রমিক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ না পারলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে গত শনিবার নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায় মাসদাইর এনএম ফ্যাশনের মালিক আব্দুল মতিন (৪৭) নামে এক গার্মেন্ট মালিক শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে না পারা এবং নানা কারনে ঋণগ্রস্থ থাকায় আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।

অপরদিকে কেউ কেউ পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের জন্য ঈদ মার্কেট করতে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা তুলছে। কেউবা ঈদে বিদেশ ভ্রমনের জন্য ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এছাড়া গত প্রায় ৬ মাস থেকেই ব্যাংকে টাকার ভয়াবহ সঙ্কট বিদ্যমান। পাশাপাশি জুন মাস অর্থবছরের শেষ মাস। ব্যাংক ক্লোসিং’র মাস। এটা নিয়েও চিন্তিত ব্যাংকগুলো। অর্থ সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংকগুলোর নিয়মবহির্ভূত ঋণ দেয়াকে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো কোনো ব্যাংকের আমানত কমে গেলেও স্বার্থসংিশ্লস্ট ঋণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকটি বাধ্য হয়ে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বেতন ও বোনাস পরিশোধে ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকার লেনদেন বেড়ে গেছে। কিন্ত চাহিদার তুলনায় গ্রাহকের নগদ টাকা সরবারহে অধিকাংশ ব্যাংক কুলিয়ে উঠতে পারছে না। গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট-খাতের লেনদেনগুলো ছাড় দিলেও বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলন করতে অনুৎসাহিত করছে ব্যাংক। আবার অনেক দিন আগে থেকে ব্যাংককে বলে রাখতে হয়। ব্যাংকে টাকা থাকা সত্বেও প্রয়োজনে টাকা না পাওয়ায় অসন্তোষ্ট গ্রাহকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক জানালেন, ফারমার্স ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা সত্বেও চেক দিয়ে টাকা পাচ্ছেন না তিনি। বারবার চেক বাউন্স হচ্ছে। এতে বেকায়দায় পড়েছেন ওই গ্রাহক। গত দুই দিন ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল ও গুলশান শাখায় সরেজমিন পরিদর্শন করে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঈদের আগে ব্যাংক লেনদেনের জন্য মাত্র চারটি কর্মদিবস পাওয়া যাবে। এই সময়ে বেতন-বোনাস পরিশোধের পাশাপাশি বেতনভুক্ত কর্মীসহ ব্যাংক হিসাবধারীদের ঈদ কেন্দ্রিক লেনদেনের জন্য টাকা তোলার চাপ থাকবে ব্যাংকে। হিজরি সন অনুযায়ী এবার ২৯ রোজা শুক্রবারে পড়ায় ব্যাংক খোলা থাকছে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। এর পরপরই ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। এর মধ্যে আগামীকাল বুধবার শবেকদরের ছুটি থাকবে। ফলে আজ মঙ্গলবার এবং আগামী বৃহস্পতিবার-এই মোট দুই দিবসে ব্যাংক লেনদেন করা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, অন্য সাধারণ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের চলতি একাউন্ট থেকে এক শত কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তবে ঈদ পূঁজা পার্বণে তা বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৪০০ কোটি টাকা হয়। কিন্ত এবার তা বেড়ে ৬০০ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, ঈদ একটি বড় ধর্মীয় উৎসব। উৎসবকে সামনে রেখে আন্তঃব্যাংক ঋণ (কলমানি) লেনদেন ও সুদ হার কিছুটা বাড়ে। তবে এবার স্বাভাবিকই আছে। সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে ব্যাংক ধার নিচ্ছে। আর কলমানিতে সর্বনিম্ন সুদ হার ছিল ১ শতাংশ। গড়ে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বলেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, তারল্য সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। প্রচুর লিক্যুইডিটি আছে।

এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে টাকা নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের লম্বা লাইন বিকাল পর্যন্ত দেখা গেছে। লাইনে অপেক্ষা করে টাকা না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হতে দেখা গেছে কোন কোন গ্রাহকের। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় বিকাল পর্যন্ত টাকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে টাকা না পেয়ে বিক্ষুব্ধ কয়েকজন গ্রাহক ফিরে গেছেন। ওই ব্যাংক শাখাতে যোগযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা বলেন, উপর থেকে টাকা না পাওয়ায় আমরা টাকা দিতে পারিনি। বেসরকারি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মতিঝিল শাখাতেও দেখা গেছে গ্রাহকের লাইন। গ্রাহকদের সামলাতে ব্যাংকটিকে হিমশিম খেয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতেও টাকা উত্তোলনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। আমিনুল ইসলাম মির্জা নামের এক গ্রাহক জানান, ব্যাংক এশিয়ার পল্টনের এটিএম বুথে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে তাকে প্রায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। বুথের ভিতরে টাকা উত্তোলনের দুটি মেশিন থাকলেও একটি নষ্ট। ওই বুথের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা বেলাল জানান, ঈদ হওয়াতে অনেকে গ্রাহকই টাকা উত্তোলন করছেন। তাই একটু লাইন পড়ে যায়। এছাড়া টাকা উত্তোলনের দুটি মেশিনের একটিতে তেল না থাকায় বন্ধ আছে। তাই গ্রাহকদেরকে লাইনে দাড়াতে হচ্ছে। চট্রগামের ডেনিম এক্সপার্ট লি.-এর একজন ম্যানেজার শ্রমিকদের বেতন- বোনাসের বিষয়ে ইনকিলাবকে জানান, আমরা আগেই বেতন-বোনাস দিয়ে দিয়েছি। তবে ২২শ’ শ্রমিকের টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে কয়েকদিন আগে ব্যাংককে বলতে হয়েছে। অন্যাথায় একসঙ্গে এতাটাকা ব্যাংক দিতো না বলে জানান তিনি।

ব্যাংক থেকে চাহিদা মাফিক টাকা পাচ্ছেন না গার্মেন্টস মালিকরা যা যা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস এবং ঈদের শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি করবে কিনা জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ’র সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, চাহিদামতো ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছেনা এ রকম কোন অভিযোগ আমি পাইনি। তবে থাকতে পারে যা আমার কাছে আসেনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং সেবায় অসন্তষ্ট গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৪ সালে মোট গ্রাহকের আট দশমিক ৬০ শতাংশ অসন্তষ্ট হয়ে ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেয়। ২০১৫ সালে এ ধরনের গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৮১টি ব্যাংক হিসাব বন্ধ হয়েছে অসন্তষ্টির কারণে, যা দেশের মোট ব্যাংক হিসাবের সাড়ে ১২ শতাংশ।

এ সব কারণে ব্যাংকে আমানককারীর সংখ্যা কমছে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এই বছরের মার্চ পর্যন্ত-এই তিন মাসে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতে জনগণের রাখা আমানতের পরিমাণ নয় লাখ ২৬ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। তিনমাস পর অর্থাৎ মার্চ শেষে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের খারাপ অবস্থার কারণে সরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। এর ফলে কিছু ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে পড়েছে। কিন্তু বাকি ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত তারল্য পড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিনমাসে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নেওয়া হলেও এই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৫ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল আট লাখ ৪৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। তিনমাস পর অর্থাৎ মার্চ শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৬৯ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকতারা বলছেন, একদিকে আমানত আসছে না, অন্যদিকে ঋণ ঠিকই বিতরণ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য (এক্সেস লিক্যুইডিটি) ছিল ৯৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মার্চ শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে খেলাপি ঋণ। এর উল্লম্ফনে কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী এবার মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তা বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপির তথ্য গোপন করতে ব্যাংকগুলো নানা কৌশল অনুসরণ করে। এ সংক্রান্ত মামলায় বারবার স্টে অর্ডার বহাল রাখা, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন এবং ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ হিসাবের বাইরে রাখা হয়। সে হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণ অর্থনীতিকে ক্রমেই গ্রাস করে ফেলছে। দেশের অগ্রগতির চাকা থামিয়ে দিচ্ছে। ভালো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা এগোতে পারছেন না। বিপরীতে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের সুদহার। এ ছাড়া দুর্নীতির ফাঁদে পড়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক পুঁজি সংকটে এক রকম খোলসে পরিণত হয়েছে। পুরো পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে-দেশের ব্যাংকিং খাতে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, তিন মাসে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া বড় উদ্বেগের বিষয়। এ চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে। বেসরকারি ব্যাংকের কিছু দুষ্ট পরিচালক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলছে। এটা বড় অশনিসংকেত। এ ছাড়া ২০১০ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গঠন করার পর থেকে সরকারি ব্যাংকে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। সে ঋণগুলো বারবার খেলাপি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে পুরনো সব ঋণ একসঙ্গে খেলাপি ঘোষণা করা। তাহলে নতুন ঋণগুলো আলাদা করা যেত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ সঙ্কট প্রকট হয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের এখন নগদ টাকার সঙ্কট চলছে। অনেকেই এ সঙ্কট মেটাতে সুদহার দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে বেড়ে চলছে ঋণের সুদহার। ব্যাংকগুলোর এ ঋণের সুদহারের লাগাম টেনে ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্ত কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/136263