১২ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ২:০১

ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা হারাচ্ছে সরকার

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক বিশাল অংকের বাজেট দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেননি একবারও। বিশাল বাজেটে থাকছে বিশাল ঘাটতি। আর এ ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণ নেয়ার পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদেশী সহায়তা কমে যাওয়ায় দেশ চালাতে সরকার ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে। আবার ঋণের টাকা পরিশোধে সক্ষমতা হারিয়েছে সরকার। অন্যদিকে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের তুলনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণও। ফলে সরকারের দেনার পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

সরকার প্রতি অর্থবছরে তার বাজেট ঘাটতির চেয়ে অনেক বেশি ঋণ গ্রহণ করছে। এ কারণ সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে পুঞ্জীভূত ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সারণিতে দেখা যায়, দেশী ও বিদেশী ঋণ, গ্রহণ এবং ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করে যা থাকছে তা দিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। ফলে বাজেটে একধরণের গোঁজামিল দেয়া হচ্ছে।
উদাহরণ স্বরূপ দেখা যায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ ধরে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। তাহলে উন্নয়নের জন্য উদ্বৃত্ত থাকবে মাত্র ১২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে উন্নয়ন ব্যয় ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার জন্য বাকি ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা আসবে কোত্থেকে? দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের জোগান ১৩ হাজার ৯৭২ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ ১৬ হাজার ৩৩১ কোটি, মোট ২৯ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা হয়। বিদেশী অনুদান ৬ হাজার ২০৬ কোটি ধরলে ৩৫ হাজার ৫০৯ কোটি হয় মাত্র। আবার এ অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫২৪ কোটি রাজস্ব ব্যয় এবং ১ লাখ ৪ হাজার ৯৮২ কোটি মূলধন ব্যয়, মোট ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা দেখালেও রাজস্ব ব্যয় থেকে ৩১ হাজার ৪৩ কোটি টাকার ঋণের সুদ পরিশোধ দেখানো হয়েছে (বিবরণী ২খ)। এ ব্যয় থেকে ঋণের আসল পরিশোধ কেন দেখানো হয়নি? এ সব প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এটা শুধু ওই বছরে নয় প্রত্যেক বছরে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

এরই মধ্যে আবার আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মহিত। এতে রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ০১ শতাংশই খরচ হবে সরকারের নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ মেটাতে ব্যয় হবে ৪৮ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। আর বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে চলে যাবে ২ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ১০ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির তুলনায় কর আদায় অন্তত ১৫-১৬ শতাংশ থাকা উচিত। করের হার বাড়াতে না পারলে ঋণ কমবে না। ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। তিনি বলেন, সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় বরাদ্দ রাখতে পারছে না সরকার।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের মূল বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছিল ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছেন অর্থমন্ত্রী। আবার বর্তমান সরকারের শেষ বাজেটে রাজস্ব ব্যয়ের যে ফর্দ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তৈরি করেছেন তাতে ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকাই চলে যাবে ঋণের সুদ পরিশোধে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ঋণনির্ভর বাজেট দিয়েই চলছে। এ সরকার ২০১৩-১৪ সালে মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আসল ও সুদ ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬০২ কোটি টাকা পরিশোধ করে। ২০১২-১৩ সালে মোট ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আসল ও সুদ ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে; ২০১১-১২ সালে ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আসল ও সুদ ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা পরিশোধ করে। এসব ঋণের প্রধান অংশই হলো অভ্যন্তরীণ, যার পরিমাণ বিগত কয়েক বছর আগেও নগণ্য ছিল। সরকার নিজেকে ঋণমুক্ত না করে ঋণ রিশিডিউলিংয়ের মতো আরো ঋণ নিয়ে এর আসল ও সুদ পরিশোধ করে চলছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ছিল ১৫ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটে নির্ধারিত নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’র পর্যালোচনায় বিদেশি ঋণের বিপরীতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারকে ২০ কোটি ২১ লাখ ডলার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা দেশের মোট রাজস্ব আয়ের ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং মোট রফতানি ও প্রবাসী আয়ের ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে আগের বছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট দেশীয় ঋণের স্থিতি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, দেশে বৈদেশিক ঋণও ব্যাপক হারে বাড়ছে। বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি জিডিপির ১২ শতাংশ। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ হাজার ৬৩০ কোটি ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ সালে যা ছিল ২ হাজার ৩৯০ কোটি ডলার। এ ঋণ বৃদ্ধি বর্তমানেও অব্যহত রয়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণের সুদের হারও বাড়ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৯২ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে ১২৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলারে উন্নীত হয়। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পরিশোধের পরিমাণ কমে ১০৫ কোটি ৫ লাখ ডলারে নেমে আসে। অন্যদিকে ২০১৪-১৫ সালে বৈদেশিক ঋণের সুদ ছিল ১৮ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০ কোটি ২১ লাখ ডলারে উন্নীত হয়। ইআরডি সূত্র জানায়, ২০১১-১২ অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের মধ্যে আসল ছিল ৭৬ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। অপরদিকে সরকারকে এ সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৯ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। এর আগের ২০১০-১১ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৯২ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ৭২ কোটি ৯২ লাখ ডলার ও সুদ দিতে হয়েছে ২০ ডলার। সেই হিসেবে ২০১০-১১ অর্থ বছরের তুলনায় ২০১১-১২ অর্থবছরে সুদাসল মিলে প্রায় ৪ কোটি মার্কিন ডলার বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়।

প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার টাকা। গত এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার টাকা। আগামী এক বছরে তা আরও সাড়ে ৭ হাজার টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৮৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ৮ লাখ ৬২ হাজার ২২৪ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে ৯৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ৬০ হাজার টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৫১ হাজার ৭৫৫ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার টাকা। এরপর আগামী অর্থবছরে আরও ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। ফলে ঋণের স্থিতি আরও ৭ হাজার ৫০০ টাকা বাড়বে। এ দিকে ২০০১-০২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১১৫ দশমিক ৫২ মার্কিন ডলার। যা ২০০৬-০৭, ২০১০-১১ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যথাক্রমে ১৩৬ দশমিক ৪৫, ১৫৭ দশমিক ৭ এবং ১৭৩ দশমিক ৫৩ ডলার ছিল। আর মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২০০১-০২ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪৩৩ টাকা ছিল। যা ২০০৬-০৭, ২০১০-১১, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫ হাজার ৫৩৩, ৯ হাজার ২৯২, ১২ হাজার ৯৬৮ ও ১৩ হাজার ৯৮৯ টাকায় দাঁড়ায়। অভ্যন্তরীণ মাথাপিছু ঋণ বৃদ্ধির এ প্রবণতা বিবেচনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমান ১৬ হাজার টাকায় দাঁড়ায়।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, তুলনামূলকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। এতে আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যায়। সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে।

 

http://www.dailysangram.com/post/333967