১১ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:০৯

ঢাকায় বসতে পারেননি নন এমপিও শিক্ষকরা

প্রস্তাবিত বাজেটেই কপাল খুলছে নন-এমপিও ও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি সরকারি চাকরিজীবীদের মতো বার্ষিক পাঁচ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৌশলগত কারণে বিষয়টি প্রস্তাবিত বাজেটে স্পষ্ট করা হয়নি। তবে আগামী ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পাসের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারেন বলে অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি স্বীকার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষকদের জন্য সুখবর আছে।

তবে একটু অপেক্ষা করতে হবে। বাজেটে সুস্পষ্ট ঘোষণা না থাকার বিষয়ে সচিব বলেন, সব কিছু বাজেটে থাকবে বিষয়টি এমন নয়। এটি হয়তো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দ থেকে ঘোষণা দিতে পারেন। এর জন্য আন্দোলন নয়, বাজেটে জাতীয় সংসদে পাস না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে বাজেটে এমপিও নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসায় ফের আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছিলেন কয়েকশ শিক্ষক। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি শুরুর আগেই পুলিশ নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আটক করে নিয়ে যায়। পরে আন্দোলন স্থগিত করার প্রুতিশ্রুতিতে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহমুদন্নবী ডলার বলেন, কর্মসূচি ঈদ পর্যন্ত স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। আমরা সেটি সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত স্থগিত করেছি। এর মধ্যে সরকারের ঘোষণা এলে আন্দোলন স্থগিত করবো।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দ থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বার্ষিক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্টে ৪০০ কোটি টাকা, বৈশাখী ভাতার জন্য ১৮৬ কোটি টাকা এবং নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করতে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। সরকার রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী বছরে শিক্ষকদের জন্য উপহার হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারেন। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে এ তিনটি খাতের কথা অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেননি। সরকারের এমন প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমেদ সাদী মানবজমিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, তাই করেন, এর প্রমাণ তিনি আগেও রেখেছেন। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, সে ওয়াদা তিনি রাখছেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বেতনের ২০ ভাগ বৈশাখী ভাতা পাবেন শিক্ষকরা।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) মহাসচিব ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষকদের দাবি আদায়ের জন্য আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিরিজ বৈঠক করেছি। শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ করায় শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। তবে ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সমাধান হবে না। এটি আরো বাড়িয়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী এ টাকা দিয়েই নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।

শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা করার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বৈশাখী ভাতা চালু করেন। তবে বঞ্চিত ছিলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এছাড়া বার্ষিক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেট পেতেন না। গত দুই বছর ধরে শিক্ষকরা বৈশাখী ভাতা ও বার্ষিক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়। তাতে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সমগ্র চাকরী জীবনে একটিমাত্র ইনক্রিমেন্ট পেতেন। জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী তারা এই সুযোগটি বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবিদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাংলা নববর্ষ ভাতা দেয়া হয় না। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, সারাদেশে চার লাখ ৭৭ হাজার ১৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। সরকারি চাকরিজীবীদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে বছরে অতিরিক্ত ৫২০ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ৩৫৬ টাকা দরকার। আর মূল বেতনের ১০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা দিতে বছরে আরো ১৭৩ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার ৪৫০ টাকা লাগবে। দুই খাতে বছরে বাড়তি ছয়শত ৯৩ কোটি ৬৫ লাখ ৬১ হাজার ৮০৬ টাকা প্রয়োজন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে সারা দেশের এক হাজার ৬০৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি) এমপিওভুক্ত করা হয়। ওই সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা অর্জন করার পরেও এমপিওভুক্তির তালিকা থেকে বাদ পড়ে। এর আগে ছয় বছর এমপিওভুক্ত বন্ধ ছিল। সবমিলে গত ১৪ বছরে মাত্র দুইবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তবে এই সময়ে সাত হাজার ১৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সব শর্ত পূরণ করেছে। সারা দেশের এমপিওবিহীন সাত হাজার ১৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করতে বার্ষিক দুই হাজার ১৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ২৫০ টাকা চাহিদা দিয়েছে মাউশি। সরকার মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরে জাতীয় সংসদের আসন অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করা হবে। সে ক্ষেত্রে আসন প্রতি ১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করা হতে পারে।

এ ব্যাপারে নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহমুদুন্নবী ডলার মানবজমিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসেই আন্দোলন স্থগিত করেছিলাম। এখন তার আশ্বাসে বাড়ি ফিরে যেতে চাই। সব প্রতিষ্ঠানকে এক সঙ্গে এমপিও ঘোষণা দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এটা না হলে অনেক শিক্ষকই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ ১৭-১৮ বছর ধরে অনেক শিক্ষক বিনাবেতনে চাকরি করছেন। তাদের বয়স প্রায় শেষের দিকে। বিচ্ছিন্নভাবে এমপিও দেয়া হলে অনেকেই বাদ পরবেন। প্রয়োজনে শিক্ষকদের বেতন চলতি বাজেটে ২০-২৫ শতাংশ দেয়া হোক। বাকিগুলো পরের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে দেয়া হোক। এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না ।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=121220