১১ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:০৫

অভিন্ন ৫৪ নদীর উজানেই অসংখ্য বাঁধ ও ক্যানেল নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেই

 বাংলাদেশে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য ৫৪টি নদীর মূল উৎসই ভারতে অবস্থিত। এই সবক’টি নদীর উজানেই অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প তৈরি করেছে ভারত। নতুন করে শুরু করেছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। যা বাংলাদেশকে এক মহা বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না। অথচ চীনের একটি বাঁধ-প্রকল্প নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতা প্রকাশ এবং এজন্য মিডিয়ায় সরব হওয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

গত ৩১ মে ২০১৮ ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোয়াজ্জেম আলী ‘চীন ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করছে- এমন খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেখানে এক অনুষ্ঠানে তিনি চীন-বাংলাদেশের মধ্যে নৈকট্য নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নিরসনেরও চেষ্টা করেন বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি ১৯৭১ সালের কথা ভুলে যাইনি।’ ভাষ্যকাররা বলছেন, চীনের কথিত প্রকল্প নিয়ে হাইকমিশনার যে পরিমাণ উদ্বেগ প্রকাশ করেন তার সামান্য অংশও যদি ভারতের তৈরি অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প বিষয়ে করতেন তাহলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারতো। ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পসহ বাংলাদেশমুখী সবক’টি নদীর উজানেই অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প তৈরি করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে- সেবিষয়ে বাংলাদেশ পক্ষের সেরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ না পাওয়ায় জনমনে হতাশা দেখা দিয়েছে।

শত-সহস্র বাঁধ-প্রকল্প : বাংলাদেশমুখি আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে ভারত শত-সহস্র বাঁধ ও প্রকল্প নির্মাণ করে চলেছে। হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহারের এক বিপুল কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে ভারত। এর ফলে শুধু পদ্মা কিংবা যমুনা নয়, বাংলাদেশের সমস্ত নদীই ব্যাপকভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। ‘গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিন’ বলে যে নদী-উপত্যকা বিরাজমান বাংলাদেশে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়তে চলেছে। একসময় তা মরুময় হয়ে পড়বে বলেও বিশেষজ্ঞদের আশংকা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রবাহিত অন্তত ৫৪টি নদীর উৎস ভারতে অবস্থিত। এর প্রায় প্রত্যেকটিতেই ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং তাদের অংশে এসব নদী-উপত্যকায় সেচ প্রকল্প বা বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে। এর ফলে এসব নদীর পানি প্রবাহ বাংলাদেশ অংশে সীমিত হয়ে পড়েছে।

গঙ্গা বেসিনকে কেন্দ্র করে বৃহৎ প্রকল্প : বহুল আলোচিত ফারাক্কা ব্যারেজ ছাড়াও গঙ্গা বেসিনকে কেন্দ্র করে যে সকল বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, মধ্য গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, লোয়ার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, ইস্ট গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, আগ্রা গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, ইস্টার্ন ইয়ামুনা (যমুনা) ক্যানেল প্রজেক্ট, ওয়েস্টার্ন ইয়ামুনা (যমুনা) ক্যানেল প্রজেক্ট, বেতওয়া ক্যানেল প্রজেক্ট, ধাসান ক্যানেল প্রজেক্ট, কেন ক্যানেল প্রজেক্ট, ঘাগর ক্যানেল প্রজেক্ট, সারদা ক্যানেল প্রজেক্ট, তেহরি ড্যাম প্রজেক্ট, লাখওয়ার ড্যাম প্রজেক্ট, তপোবন ভিষ্ণুগড় প্রজেক্ট, রামগঙ্গা মালটিপারপাস প্রজেক্ট, ধালিপুর হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাইহান্ড ড্যাম, চিলা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, তানাকপুর ব্যারেজ, কিসাউ ড্যাম, মানেরি ভালি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খারা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খোদরি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, ছোবরো হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাজঘাট ড্যাম, হালালি ড্যাম, গান্ধি সাগর ড্যাম, রাণাপ্রতাপ সাগর ড্যাম, জাওহার সাগর ড্যাম, চম্বল ভ্যালি প্রজেক্ট, ওবরা ড্যাম, বনসাগর টোনস ড্যাম, পার্বতি ড্যাম, মাতাতিলা রিজার্ভার, রামসাগর ড্যাম, মাশানজোড় রিজার্ভার, ধাউলিগঙ্গা পাওয়ার প্রজেক্ট, তিলাইয়া ড্যাম, কনোর ড্যাম, মাইথোন ড্যাম, পানচেট ড্যাম। ভারত গঙ্গা বেসিন এলাকায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সর্বমোট প্রায় ২১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এরমধ্যে চিহ্নিত ১৪২টি প্রকল্প থেকে প্রায় ৫,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। ভারত ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউমেক পানি হুগলী ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। এর ফলে একদিকে হুগলী নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়ে কোলকাতা পোর্ট সারাবছর সচল থাকবে এবং অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা যাবে। এখানেই শেষ নয়, ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি রুপি। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ধারায় প্রকল্প : ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র দু’টি অববাহিকায় পানির ৩৩টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করতে চলেছে। প্রতিটি সঞ্চয়াগারের ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ৫০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ ৩৩টি সঞ্চয়াগারের সর্বমোট ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি। এ পানি ভারতের পূর্ব, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। এর আওতায় থাকবে ৩ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমি। পাশাপাশি উৎপাদন করা হবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ। ইতোমধ্যে স্থাপিত বাঁধের মাধ্যমে ভারত ৩৫ লাখ কিউসেক পানি ধরে রেখেছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত এসব সঞ্চয়াগারের মাধ্যমে ধরে রাখতে সক্ষম হবে ৫০ লাখ কিউসেক পানি। বাড়তি ১৫ লাখ কিউসেক পানির ঘাটতি বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে। এর মধ্যে বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত টিপাইমুখ হলো বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কি.মি পূর্বে বরাক নদীতে এবং তুইভাই-বরাক নদীর সঙ্গমস্থল থেকে মনিপুর রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে সংকীর্ণ গিরিখাতে অবস্থিত টিপাইমুখ স্থানে ভারতের নির্মিতব্য বাঁধ। দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ভারত ১৬১ মিটার উঁচুতে ৩৯০ মিটার দীর্ঘ বাঁধ দিয়ে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ২০১২ সালের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। টিপাইমুখ ড্যাম বা জলাধারে মোট পানি ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ১৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই জলাধারে পানি জমিয়ে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ অংশ পানি বঞ্চিত হবে এবং পূর্বাঞ্চলের বিশাল ভূ-ভাগ ভূ-তাত্ত্বিক প্রতিকূলতার শিকার হবে।

তিস্তার উপরে ৩৫ প্রকল্প : ভারত আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার উপরেও বহু সংখ্যক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের জন্য বিশাল বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে পানি সংরক্ষণের জন্য। এর ফলে তিস্তার পানি ভারতের অভ্যন্তরেই থেকে যাবে। এর আগে তারা পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গজলডোবা নামক স্থানে তিস্তা নদীর ওপর যথারীতি একটি ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। যা বৃহৎ একটি সেচ প্রকল্প হিসেবে কাজ করছে। এবার ভারত তার অংশের তিস্তার পুরো অংশকে কাজে লাগিয়ে ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় পানির বৃহৎ বৃহৎ রিজার্ভার গড়ে তোলা হবে এবং এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। উল্লেখ্য, তিস্তা বাংলাদেশেরও নদী এবং তা ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহেরও অন্যতম উৎস। তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া মানেই ভাটিতে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্য এবং সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।

বরাক ও উপনদীগুলোতে ৩০ প্রকল্প : ভারত আন্তর্জাতিক নদী বরাক ও তার উপনদীগুলিতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ছোট-বড় এসব প্রকল্প-বাঁধের মাধ্যমে ভারত প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বরাক ও তার শাখা ও উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই কাজ চলছে। এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেচ ব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। এসব বাঁধের কারণে বরাক নদীতে কার্যত ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ হবে বরাকের পানি থেকে বঞ্চিত। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা নদী পানিশুন্য হয়ে পড়বে।

অন্যান্য নদীতেও বাঁধ : ভারত প্রায় প্রতিটি বাংলাদেশমুখি নদীতে নানা ধরনের বাঁধ তৈরি করেছে। এখানে কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার উজানে ভারত মহানন্দা নদীতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। বাঁধটি ২০০ মিটার প্রশস্ত। ইংরেজি এল আকৃতির এ বাঁধটিতে ২৫টি গেট রয়েছে। এ বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটিতে নদী ক্ষীণ ধারায় বয়ে চলছে। বাঁধে সংযুক্ত করা হয়েছে ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ চ্যানেল। এই চ্যানেলের সাহায্যে ভারত মহানন্দা ব্যারেজ থেকে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ১৫টি নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে জলপাইগুড়ি জেলার আমবাড়ি-ফালাকাটায় করতোয়া নদীর ওপর একটি ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। এটি এখন তিস্তা ব্যারেজের আওতায় আনা হয়েছে। তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেল থেকে একটি ফিডার ক্যানেল দিয়ে ৪২৫ কিউসেক পানি করতোয়া ব্যারেজে নিয়ে আসা হচ্ছে। বাংলাদেশে করতোয়া এখন শীর্ণ একটি নদী। শুকনো মওসুমে করতোয়া পানিশূন্য হয়ে পড়ে।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প : ভারত নতুন করে বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এই প্রকল্পের অধীনে মোট ৩৭টি নদীকে ৩০টি সংযোগ খালের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে। এসব খালের মোট দৈর্ঘ্য হবে আনুমানিক ১২ হাজার কিলোমিটার। পরিকল্পনা অনুযায়ী সংযোগ খালগুলো ৫০-১০০ মিটার প্রশস্ত ও প্রায় ৬ মিটার গভীর হবে। এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা এই প্রধান নদী দুটি সংযোগ খালের সাথে যুক্ত করা। এ জন্য সংযোগ খালের সাহায্যে তিস্তা নদী গিয়ে প্রথম ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আনা হবে। ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে সংযোগ খাল কেটে উড়িষ্যার সুবর্ণ রেখা ও মহানদী পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের এই অংশটি পশ্চিম বাংলা ও আসাম রাজ্যে বাস্তবায়িত হবে। অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ও ভাইগাই নদীগুলোকে সংযুক্ত করা হবে। এই প্রকল্পটি উড়িষ্যা, অন্ধপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। অন্য একটি প্রকল্পে গঙ্গা নদীর কয়েকটি উপনদী যথা গন্ডক, ঘাগরা, সারদা ও যমুনা যুক্ত করা হবে, পরে যমুনা থেকে খাল কেটে পানি সুদূর রাজস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। আর একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে সাবরমতী নদীর পানি আগে উল্লিখিত ধারার সাথে যুক্ত করে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পানি সরবরাহ করা হবে। এই প্রকল্পে শুধু সংযোগ খালই খনন করা হবে না। পানি ধরে রাখার জন্য এবং ধরে রাখা পানিকে নদী প্রবাহের প্রাকৃতিক গতির বিপরীত দিকে প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন স্থানে বাঁধ, ব্যারেজ ও জলাধার নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়াও অনেকগুলো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় : ভারত পদ্মা-যমুনা বেসিনে যে অসংখ্য মূল সেচ ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণ করছে তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের শত শত নদী ও খালবিল পর্যায়ক্রমে পানিশূন্য হয়ে পড়বে। এর প্রতিক্রিয়ায় এমনকি মেঘনা ও তার শাখাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের কিছু এলাকা ছাড়া বাকি বৃহত্তর রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলার ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় ৭ কোটি অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোকই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লাখ লাখ হেক্টর কৃষি জমি হারাবে আবাদের যোগ্যতা। এই সকল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পুরো অববাহিকা এক সময় মরুভূমিতে পরিণত হবে। দেশে এ যাবত ফারাক্কা, তিস্তা ও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা হলেও সামগ্রিক প্রকল্পগুলো সম্পর্কে তেমন কোন আলোচনাই হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো: খলিলুর রহমান তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করার পর ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত প্রধানত তিস্তা, মহানন্দা, মনু, গোড়াই, গোমতী, ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি নদীর পানি তুলে নিয়ে এদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার এক হীন চক্রান্তে লিপ্ত। এই সব অভিন্ন নদীর উজানের পানি যদি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তুলে নেয় তা হলে আমাদের যে ক্ষতি হবে তা ভয়াবহ, আমাদের স্বাভাবিক জীবনধারা বদলে যাবে, সবকিছুর আমূল পরিবর্তন হবে, শস্য শ্যামলা, নদীমাতৃক বাংলাদেশের যে প্রাকৃতিকগুণ তা আর থাকবে না, মানুষের মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, চেহারা সব কিছুর পরিবর্তন হয়ে যাবে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী এম. ইনামুল হক গত বুধবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ‘চীনের যে বাঁধ-প্রকল্প নিয়ে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেই বাঁধ তো হাজারো কিলোমিটার দূরের প্রকল্প। কিন্তু বাড়ির পাশে ভারত যে অসংখ্য বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে- সে ব্যাপারে বক্তব্য কোথায়? এ বিষয়ে বাংলাদেশের হাই কমিশনার অধিকতর সাহসী হয়ে বক্তব্য প্রদান করবেন- এটাই আমরা আশা করি।’

http://www.dailysangram.com/post/333848