১০ জুন ২০১৮, রবিবার, ১১:২৩

মাছশূন্যের শঙ্কা বঙ্গোপসাগরে

বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে সর্বনি¤œ অক্সিজেন শূণ্য জোন বা অঞ্চল। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী আগস্টের মধ্যেই আরও অনুসন্ধান চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণার জন্য জাতিসংঘের সহায়তায় নরওয়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমুদ্র জরিপ গবেষণা জাহাজ ‘আরভী ড. ফ্রিটজফ নেনসেন-৩ শ্রীলংকা থেকে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় আসছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন শূণ্য জোন সৃষ্টির ব্যাপারে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধান ও গবেষণা চলছে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ সাগর-মহাসাগরে এ ধরনের অক্সিজেন-শূণ্য জোন তৈরি হতে পারে। যা সাম্প্রতিক সময়ের আবিস্কার। জ্বালানি তেল, পোড়া তেল, গ্যাস ও কয়লা জ্বালানোর কারণে এসব জ্বালানির বর্জ্য এবং জমিতে ফল-ফসল ক্ষেত-খামারে অনিয়ন্ত্রিত হারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে সেগুলোর অবশেষটুকু খাল-বিল নদ-নদী হয়ে সাগরে গিয়ে মিশছে। এই নাইট্রাস অক্সাইড সাগরতলকে করে তুলছে অক্সিজেন শূণ্য।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, সাধারণত সাগর-মহাসাগরের কমপক্ষে ২০০ মিটার নিচে অক্সিজেন শূণ্য জোন তৈরি হতে পারে। ২০১৬ সালে ভারতসহ কয়েকটি দেশের সমুদ্র বিজ্ঞানী গবেষকদের অনুসন্ধানে বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন শূণ্য জোন থাকার বিষয়টি সর্বপ্রথম ধরা পড়ে। আর এটি প্রথম ‘ন্যাচার জিও-সায়েন্সে’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। এ ধরনের অক্সিজেনহীন কিংবা শূণ্যের কাছাকাছি অক্সিজেন জোন থাকলে মূল্যবান মৎস্য সম্পদসহ সামুদ্রিক প্রাণিকূল, জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদরাজি ও তাদের প্রাকৃতিক খাদ্য-শৃঙ্খল মারা পড়বে অথবা অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। অধ্যাপক সাইদুর রহমান ইনকিলাবকে আরও বলেন, এই জোন বাংলাদেশের সমুদ্র সীমার ৬০০ থেকে ৭০০ মাইল দূরে বলে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল মহিসোপান হচ্ছে বাংলাদেশের সামুদ্রিক সীমা। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে অনুসন্ধান চালানো হবে। এর মাধ্যমে অক্সিজেন শূণ্য জোনের সঠিক অবস্থান, সম্ভাব্য বিস্তার ও বিরূপ প্রভাব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সহকারে অনুসন্ধান পরিচালনা করা হবে। সাগর-মহাসাগরে ‘অক্সিজেন-শূণ্য’ জোন সৃষ্টির বিষয়টি অনুসন্ধানে আবিস্কৃত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ বছর আগে। আর একশ’ বছরে বিশ্বজুড়ে উত্তরোত্তর শিল্পায়নের পর এটি নতুন এক সঙ্কট হিসেবে ক্রমেই তৈরি হয়। সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক সাইদুর রহমান জানান, শিল্পায়ন, কল-কারখানা প্রসার, পরিবহনসহ অনেক খাতে তেল-কয়লা-গ্যাস প্রভৃতি জ্বালানি পোড়ানোর হার বেড়েই চলেছে। আবার কৃষি-খামার ফল-ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির আশায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরিয়াসহ বিভিন্ন সারের নাইট্রোজেন হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত এবং নিয়ন্ত্রণহীন প্রয়োগ।

জমি ক্ষেত-খামারে ব্যবহৃত উক্ত দু’টি উৎস থেকে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে খাল-বিল, জলাশয়, হ্রদ, নদ-নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশছে। এতে করে সাগরের পরিবেশে ও উদ্ভিদ, জীববৈচিত্রের মাঝে ‘নাইট্রাস অক্সাইড’ থেকে পরিণত হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর ‘নাইট্রাইড’। এর ফলে সমুদ্র পরিবেশে এককোষী শৈবাল সৃষ্টি ও এর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখান থেকে (ডি-কম্পোজ) নিয়মে সৃষ্টি ও খুব দ্রæত প্রাদুর্ভাব ঘটছে ব্যাকটেরিয়ার। এসব মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান সাগরতলের অক্সিজেন খেয়ে করে ফেলছে।
তিনি জানান, ২০১৬ সালে ফিজিক্যাল সমুদ্র বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক প্রতিবেদনে বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন শূণ্য জোনের সন্ধান পান। আর এর পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়, সেই এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য ও প্রাণিকূল হয় মারা গেছে, মারা যাচ্ছে নতুবা বিরূপ পরিবেশের সঙ্গে টিকতে না পেরে অন্যত্র চলে গেছে। মৎস্যসহ প্রাণিকূল বা জীববৈচিত্র্যের বাঁচার জন্য অক্সিজেনের উপস্থিতি অপরিহার্য।

মানবসৃষ্ট অপরিণামদর্শী কর্মকাÐের পরিণতিতে বঙ্গোপসাগর হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক অক্সিজেনের মাত্রা। অতিমাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের কারণে গেøাবাল ওয়ার্মিং বা ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা’ বৃদ্ধির বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে উদ্বেগ আর ডামাডোলের যেন শেষ নেই। তবে সাগর-মহাসাগরে ‘নাইট্রাস অক্সাইড’ দ্রবীভূত হয়ে মিশ্রণের ভয়াবহতার দিকটি এখনও চাপা পড়ে আছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সাগর-উপসাগর, মহাসাগর পরিবেষ্ঠিত দেশসমূহ ‘বøু-ইকোনমি’ বা ‘সামুদ্রিক অর্থনীতি’র সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে সভা-সেমিনার ও গবেষণা চলেছে। অথচ নাইট্রাড দূষণে সাগরে অক্সিজেন শূণ্যতার বিষয়টি সম্পর্কে মাথাব্যাথার ফুরসৎ যেন নীতি-নির্ধারক মহল এবং গবেষকদের মোটেও নেই। যদিও পুরো ব্যাপারটি অদূর ভবিষ্যতে সামুদ্রিক পরিবেশ ও সম্পদের ক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিস্থিতির অশনি সঙ্কেত বহন করছে।

অক্সিজেন জোন প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাইদুর রহমান জানান, সাধারণত সাগরের পানির ২০০ থেকে দেড় হাজার মিটার নিচে অক্সিজেনবিহীন জোন সৃষ্টি হতে পারে। এর চেয়ে কম গভীরতায় হয় না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মহিসোপানের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ অংশের গভীরতা ২০০ মিটারের কম। তবে অনুসন্ধানে ২০০ মিটারের চেয়েও গভীর সাগরতলে বাংলাদেশের পানিসীমায় অথবা খুব কাছাকাছি অক্সিজেন শূণ্য জোন পাওয়া যায় তাহলে মূল্যবান মৎস্য সম্পদসহ সমগ্র জীববৈচিত্র্য, প্রাণিকূল বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি অস্বীকার করার উপায় নেই।
বড় আকারের প্রাণিকূল বা মাছ, তিমি-হাঙর প্রভৃতি অক্সিজেন শূণ্য জোন এড়িয়ে দ্রæত পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর ছোট আকারের কোটি কোটি প্রাণিকূল এবং তাদের খাদ্য-শৃঙ্খল বেঘোরে মারা পড়ে। সাগরের পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর মানুষের আত্মঘাতি খড়্গের পরিণতিতেই প্রকৃতি তার আপন নিয়মের ধারায় বিরূপ হয়ে উঠছে। সামুদ্রিক সম্পদরাশি থেকে মানুষ বঞ্চিত করছে নিজেকে নিজেই।

অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরের অক্সিজেন শূণ্য জোন সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্টভাবে জানার চেষ্টা চলছে। জোনটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে কত দূরে? বাংলাদেশের পানিসীমার দিকেও ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কিনা? আগামী আগস্টে গবেষণার পরই ফলাফল মিলতে পারে।
সমুদ্র গবেষণা জাহাজ ‘আরভী ড. ফ্রিটজফ নেনসেন-৩’ শ্রীলংকার কলম্বো থেকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার দিকে আসার পথে দুই একদিন ধরে বঙ্গোপসাগরের উক্ত অক্সিজেন শূণ্য জোন অতিক্রম করে আসবে। সেই সময় গবেষক টিমের একজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. সুব্রত সরকার ওইু জাহাজে থাকবেন। তিনি এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। এরপর আমরা তা পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হতে পারবো।

https://www.dailyinqilab.com/article/135904