১০ জুন ২০১৮, রবিবার, ১১:২১

ফের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে যাচ্ছেন ননএমপিও শিক্ষকরা

প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে বরাদ্দ থাকবে সেই আশায় বুক বেঁধে থাকতে থাকতে ১৭ বছর পার করেছেন কয়েক হাজার শিক্ষক। এবার বাজেটের আগে সে আশায় ভরসা জুগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
পক্ষে দেয়া আশ্বাস। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে কোনো বরাদ্দ না রাখায় হতাশ হয়েছেন শিক্ষকরা। তাই বাধ্য হয়ে স্থগিত কর্মসূচি ঈদের আগেই ফের শুরু করছেন তারা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ফের অবস্থান কর্মসূচি শুরু করছেন শিক্ষকরা।

শিক্ষক নেতারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সরকারের আশ্বাস পরবর্তীকালে সংসদে দাঁড়িয়ে এমপিও দেয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা যতটাই আশায় বুক বেঁধেছিলাম, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শুনে ততটাই হতাশ হয়েছি।
তাই ফের আন্দোলনে যেতে বাধ্য হচ্ছি। শিক্ষকরা জানান, বিনা বেতনের চাকরি করতে করতে সংসার চালানো এখন প্রায় দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ১৭ বছরে বেশি সময় পর এখন অন্য কোনো চাকরি করার বয়স ও শক্তি সামর্থ্য কোনোটিই নেই। তাই বাধ্য হয়ে বিনা বেতনে চাকরি করতে হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি বাজেট আসলেই সরকার আমদের আশ্বাস দেয়। এবার আমাদের আন্দোলনের পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাজেটে এমপিও দেয়া হবে। সে প্রতিশ্রুতি সরকার রাখল না।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রস্তাবিত বাজেট তুলে ধরেন। তাতে তিনি জানান, শিক্ষার মোট ৫৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে ২২ হাজার ৪৬৬ কোটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ২৪ হাজার ৮৮৮ এবং কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগে পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়নি।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার মানবজমিনকে বলেন, সরকার আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এমপিওভুক্তির কোনো ঘোষণা দেয়া হয় না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি পেয়ে আন্দোলন স্থগিত করেছিলাম। বাধ্য হয়ে আবার শুরু করছি। তিনি বলেন, সংশোধিত বাজেটে নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা দেয়ার দাবিতে রোববার থেকে আমরা লাগাতার আন্দোলন শুরু করবো। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে সারা দেশের এক হাজার ৬০৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি) এমপিওভুক্ত করা হয়। ওই সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা অর্জন করার পরেও এমপিওভুক্তির তালিকা থেকে বাদ পরে। এর আগে ছয় বছরও এমপিওভুক্তি বন্ধ ছিল। সবমিলে গত ১৪ বছরে মাত্র দুবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তবে এই সময়ে পাঁচ হাজার ২৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সব শর্ত পূরণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের ডাকে গত ২৬শে ডিসেম্বর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রথম অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। ৩১শে ডিসেম্বর থেকে তীব্র শীতের মধ্যে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। কর্মসূচি পালনকালে গত ২রা জানুয়ারি হঠাৎ সেখানে গিয়ে হাজির হন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আন্দোলনরত শিক্ষক নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী বলেন, গতরাতে আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক চেষ্টার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে পেরেছি। তিনি সম্মতি দিয়েছেন, এমপিওভুক্ত যারা হননি, তাদের এমপিওর ব্যবস্থা করা হবে। এটা আমাদের বিজয়, প্রথম স্বীকৃতি। শিক্ষামন্ত্রী তখন আরও বলেছিলেন, আমি কথা দিচ্ছি এমপিওভুক্তির দাবি পূরণ করে দেব। টাকা, পয়সা, অর্থের ব্যাপার আছে। অর্থমন্ত্রী রাজি হয়েছেন, আমরা কাজ এগিয়ে রেখেছি। নীতিমালা করে দিয়ে বলেছি- এটা দিলাম, আপনারা দেখেন। আপনারা (শিক্ষক) শিক্ষা পরিবারের সদস্য, আমি একজন কর্মী। আপনারা খুবই কষ্ট করছেন, দুঃখিত। আপনারা কয়েক দিন ধরে এখানে আছেন। শিক্ষকরা আমাদের মাথার মণি, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, নিয়ামক শক্তি। শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা কেউ গ্রহণ করে না।
শিক্ষামন্ত্রীর ওপর আস্থা না রেখে শিক্ষকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে ৫ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ সাজ্জাদুল হাসান ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। ওই দিনই শিক্ষকরা আন্দোলন স্থগিত করে বাড়ি ফিরে যান। এমপিও ছাড় করতে অর্থ বরাদ্দ দিতে অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসের পরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এমপিও ছাড়ের নীতিমালা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠান। অর্থ মন্ত্রণালয় নীতিমালা অনুমোদন দিলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এখাতে কোনো বরাদ্দ রাখেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জানুয়ারি মাসেই এমপিওভুক্তির অর্থ চাহিদা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

তাতে বলা হয়েছে, সারা দেশের এমপিওবিহীন সাত হাজার ১৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করতে বার্ষিক দুই হাজার ১৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ২৫০ টাকা লাগবে। এর মধ্যে এক হাজার ২২৭টি নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২১৯ কোটি ৭১ হাজার ৩০০ টাকা, এক হাজার ৮৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৩৬৮ কোটি ১৫ লাখ ২৭ হাজার ৮৫০ টাকা, তিন হাজার ২৭৫টি এমপিওভুক্ত নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৫২২ কোটি ৬০ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ টাকা, ৫১৮টি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের কলেজ শাখার জন্য ৩৫৭ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ টাকা এবং এক হাজার ৩৩টি কলেজের ডিগ্রি স্তরের এমপিওভুক্তিতে ৭১৭ কোটি ৩৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৫০ টাকা লাগবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাজেটে সমপরিমাণ অর্থবরাদ্দের দাবি জানালেও অর্থ মন্ত্রণালয় তাতে সায় দেয়নি।

এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ (বিদ্যালয়-২) বলেন, বাজেট এখন আমরা ভালো মতো দেখতে পারিনি। বাজেট এখনও ফাইনাল না। বাজেট সবেমাত্র উপত্থাপনা হয়েছে। ৩০শে জুন পাস হবে। এরমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটবে। কোনো খাতে বাজেট কমবে, কোনো খাতে বাড়বে। এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে মন্ত্রী ও সচিব এ নিয়ে কাজ করছেন বলে তিনি জানান।

এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকরা ২০১৩ সালে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। ওই বছরের ১০ই জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশ পিপার স্প্রে মেরে সরিয়ে দেয়। পাঁচ দিন পরে ন্যাম ভবনের সামনে অনশন কর্মসূচি করতে গেলে মানিক মিয়া এভিনিউর পশ্চিম পাশে পুলিশ বাধা দেয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থান করেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ওই ঘটনার পর শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তিন মাসের মধ্যে এমপিওভুক্তির আশ্বাস দেন। এই আশ্বাসে পেরিয়ে যায় দুই বছর। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রথমে শহীদ মিনারে সমাবেশ এবং পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন পালন করে নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন। সমাবেশ থেকে বলা হয়, সুস্পষ্ট ঘোষণা না এলে এই আন্দোলন চলবে। সরকার আবারও এমপিওভুক্তির আশ্বাস দেয়। ওই আশ্বাসের পর কেটে যায় এক বছর। এরপর ২০১৬ সালে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ না রাখায় আবার রাজপথে নামেন শিক্ষকরা। ওই সময় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে এমপিওভুক্তিতে অর্থ বরাদ্দ রাখার আশ্বাস দেয় সরকার। কিন্তু এ বাজেটেও বরাদ্দ রাখা হয়

http://mzamin.com/article.php?mzamin=121078