১০ জুন ২০১৮, রবিবার, ১১:২০

চাপ বাড়বে ব্যাংক ঋণে

ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারীদের কিছু হবে না, পকেট ভারি হবে পরিচালকদের

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক ঋণের ওপর চাপ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদহার কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের ওপর আশানুরূপ বিনিয়োগ পাওয়া যাবে না। কাক্সিক্ষত হারে বিদেশী ঋণ পাওয়া না গেলে পুরো বাজেট ঘাটতি ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এতে কম সুদে ঋণ পাবেন না সাধারণ গ্রাহক। এ দিকে শর্তহীনভাবে করপোরেট কর কমানোর সুযোগ দেয়ায় ঋণগ্রহীতা বা আমানতকারীদের স্বার্থে কোনো কিছু হবে না, শুধু পকেটভারী হবে ব্যাংক পরিচালকদের এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এ বিষয়ে ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাজেটে ব্যাংক ঋণের ওপর চাপ বাড়বে। কিন্তু ঋণের সুদ কমানোর কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
তিনি জানান, ঢালাওভাবে করপোরেট কর কমানোর পক্ষে নন তিনি। তিনি মনে করেনÑ এ ক্ষেত্রে শর্তারোপ করার প্রয়োজন ছিল। যেসব ব্যাংক ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনবে তাদের ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমানোর সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু তা না করে ঢালাওভাবে শর্তহীনভাবে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। ব্যাংকগুলোর অপকর্মকে আরো উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এতে ঋণগ্রহীতা বা আমানতকারীদের স্বার্থে কোনো কিছু হবে না। শুধু পকেটভারী হবে ব্যাংক পরিচালকদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে এ বিষয়ে বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু সম্পদশালীদের সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকের নানা অনিয়মের কারণেই এমনিতেই সাধারণ গ্রাহকের আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমাফিক ঋণের সুদহার চাপিয়ে দিচ্ছে গ্রাহকের ওপর। সে অনুযায়ী আমানতের সুদ হার বাড়াচ্ছে না। ফলে ব্যাংকিং খাতে এখন নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে বিশাল ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে জনগণের ঋণে ভাগ বসাবে সরকার। ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিতে গেলে ঋণের সুদহার আরো বেড়ে যাবে। সাধারণ জনগণ আর কম সুদে ঋণ পাবেন না। বেশি সুদে ঋণ নিতে গিয়ে ব্যবসায়ী ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযত্রার ব্যয় বেড়ে দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিবে।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছেÑ চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ঘাটতি ব্যয়ের সংস্থানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকেই নেয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ব্যাংক বহির্ভূত খাত বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো নগদ টাকা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার তলানীতে ক্ষেত্র বিশেষ ৫ শতাংশে নেমে আসে। বিপরীতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। বেশি মুনাফার আশায় মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে থাকে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যায়। বেড়ে যায় সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ। যেখানে ২৯ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে বছর শেষে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে যায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
এ দিকে আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানো হবে বলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমে গেলে এ খাত থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। বিদেশী ঋণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাওয়া না গেলে ঘাটতি ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাবে।

এ দিকে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক গ্রাহকেরা অনেকটা আস্থার সঙ্কটে ভুগছেন। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতের ওপর। সুদ হার বাড়িয়েও কাক্সিক্ষত হারে আমানত সংগ্রহ করতে পারছেন না অনেক ব্যাংক। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এ সঙ্কট প্রকট হয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের এখন নগদ টাকার সঙ্কট চলছে। অনেকেই এ সঙ্কট মেটাতে সুদহার দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে বেড়ে চলছে ঋণের সুদহার। ব্যাংকগুলোর এ ঋণের সুদহারের লাগাম টেনে ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই কাজে লাগছে না। অনেক ব্যাংক এখন আর আগের মতো এলসি খুলছে না। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে সরকার ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে চাইলে ব্যাংকিং খাতের মধ্যে হাহাকার পড়ে যাবে। কেননা, বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাবে। যা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/324348