৯ জুন ২০১৮, শনিবার, ৮:২০

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভর্তুকি নিয়ে লুকোচুরি

লুটপাট করে বছর শেষে বাজেট থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা একটি অনৈতিক ব্যবস্থা, যা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে-খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো যখনই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, তখনই তা জনগণের করের টাকায় পূরণ করে আসছে সরকার। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ৬ বছরেই সরকার ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। আবার প্রস্তাবিত নতুন বাজেটেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে আরও ২ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংকের এবারের ভর্তুকি বরাদ্দ নিয়ে লুকোচুরি করছে সরকার। প্রতিবছর প্রস্তাবিত বাজেটে এটি আলাদাভাবে উল্লেখ থাকলেও এবার অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, এমনকি বাজেট বক্তৃতায়ও বিষয়টি এড়িয়ে যান অর্থমন্ত্রী।
ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেহেতু ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়াটা খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সরকার জানে যে আরও অনিয়ম-দুর্নীতি হবে, তাই আগাম সতর্কতা হিসেবে বাজেটেই তা রাখা হচ্ছে। ফলে ব্যাংক খাতে এ রকম বার্তা রয়েছে যে, মূলধন সংকট বা যে কোনো সংকটে পাশে আছে সরকার। এ কারণেই ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার উন্নতির পরিবর্তে উল্টো সরকারের প্রতি নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর। তবে সমালোচনা এড়াতে ভর্তুকির তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করলেও কোনো কাজ হবে না। কারণ এটি সবাই জানে যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ জোগান দেবে সরকার।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দেয়া এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। এছাড়া কর্মকর্তাদের ঋণ দেয়ার বিষয়ে দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা থাকতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাজেটে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণ বাবদ বরাদ্দ রাখা শুরু হয় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে। সরকার প্রতিবছর এ খাতে বাজেট বরাদ্দের শিরোনাম দিয়ে থাকে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’। যে টাকা ফেরত আসার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই তাকে বিনিয়োগ বলা যায় কিনা সে প্রশ্নও উঠছে এখন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটা জনগণের অর্থের চূড়ান্ত পর্যায়ের অপচয়। এ ধরনের অর্থ দেয়া কেবলই অর্থহীন। কারণ এ টাকা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কোনো উন্নতি হয়নি। আবার বলা হচ্ছে, বিনিয়োগ। যে টাকা ফেরত আসবে না তাকে কিভাবে বিনিয়োগ বলা হয়। এটা উদ্ভট এক যুক্তি।
বাজেট প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬ বছরে কখনও মূলধন ঘাটতি বা কখনও মূলধন পুনর্গঠনের নামে ছয় ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংককে দেয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। কাউকে টাকা দেয়া হয়েছে তহবিল ও ঋণ সহায়তায় আবার কাউকে দেয়া হয়েছে পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির জন্য। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূলধন ব্যয় খাতে সমমূলধন (ইক্যুইটি) বাবদ রাখা হয়েছে ২৪ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। আমাদের সন্দেহ, এখান থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হবে। এটা নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত ছিল।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও তা ছাড় করা হয়নি। পরের অর্থবছর ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও দেয়া হয় ৫৪১ কোটি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৪২০ কোটি টাকা, কিন্তু ওই ব্যাংকগুলোকে দেয় ৫ হাজার কোটি টাকা।
পরের বার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার নিজেই ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে, কিন্তু ওই টাকায়ও কুলোয়নি। ওই বছর ব্যাংকগুলোকে দিতে হয় ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ থেকে চলতি অর্থবছরসহ প্রতিবারই বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে লুটপাট করে বছর শেষে বাজেট থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা একটি অনৈতিক ব্যবস্থা, যা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এ ব্যবস্থার বিলোপ চাই। এসব ব্যাংককে মুনাফা আয়কারী প্রতিষ্ঠান হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ৬ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অথচ তিন মাস আগে অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরেই এ ঘাটতি ছিল ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। তিন মাসে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/budget-18-19/57904