৯ জুন ২০১৮, শনিবার, ৮:১৬

ভোগান্তিতে ঈদে বাড়ি যাচ্ছে না অনেকেই

ঈদের সময় গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আসা নিয়ে অসহনীয় ভোগান্তি আর হয়রানির কারণে অনেকে পরিবার নিয়ে বাড়ি যাওয়া থেকে বিরত থাকছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের আত্মীয়স্বজনের সাথে মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগের তীব্র আকফক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও যানজট, রাস্তার দুরবস্থা আর পরিবহন সঙ্কটের কষ্টের কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকে ঈদের সময় পরিবার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন না। তাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, ঈদে বাড়ি যাওয়া এবং ফিরে আসা উভয়ই সমান হয়রানি আর কষ্টের। সে কারণে অনেকে ঈদের আগে এবং পরে সুবিধামতো সময় গ্রামে যান বৃদ্ধ বাবা-মার সাথে সাক্ষাৎ করতে। আবার অনেকে পরিবার ছাড়াই একা যান গ্রামে।

রুহুল আমিন জানান, তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলায়। বাড়ি যাওয়ার ক্ষেত্রে তার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো লঞ্চে যাতায়াত। স্ত্রী ও তিন সন্তান, নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য তার দরকার লঞ্চের কেবিন। কিন্তু তিনি কখনোই ঈদের আগে কেবিনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না। রুহুল জানান, ঈদের সময় কেবিন ভাড়া অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা দিয়েও কেবিন পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন না। কারণ তিনি কোনো প্রভাবশালী লোক নন।
রুহুল জানান, লঞ্চ ছাড়া বাসেও তাদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সে ক্ষেত্রেও টিকিটের একই অবস্থা।

রুহুল আমিন বলেন, বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমাদের দুই সন্তান। আমাদের লাইনের লঞ্চের কেবিন না পেয়ে বরিশাল লাইনের লঞ্চে যোগাযোগ করে কেবিন পেলাম। রাত ৩টায় লঞ্চ বরিশাল পৌঁছার পর আমাদের তখনই লঞ্চ থেকে নামিয়ে দেয়া হলো। কারণ লঞ্চ তখনই আবার ঢাকা ফিরবে। তখন ছিল তীব্র শীত। তারই মধ্যে টার্মিনালে অপেক্ষা করলাম ভোর হওয়া পর্যন্ত। টার্মিনালে বসারও তেমন ভালো ব্যবস্থা ছিল না। আরেকবার বরিশাল হয়ে বাড়ি যাই। তখন সরকারি জাহাজে গিয়েছিলাম। সেবারও রাত ৩টায় আমাদের নামিয়ে দেয়া হয়। আর সেবার ছিল তীব্র বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের বাসে উঠতে হয়েছিল ছোট শিশু কোলে করে।
এভাবে অনেক কষ্ট করে কয়েক বছর ঈদের সময় বাড়ি গিয়েছি। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঈদের সময় আর বাড়ি যাবো না। তাই কয়েক বছর ধরে রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় না। এ কারণে অনেক সময় রোজার শুরুতে বা রোজা শুরুর আগে বাড়ি ঘুরে আসি।
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা আকরাম বলেন, তাদের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায়। বাসই মূলত তাদের বাড়ি যাওয়ার ক্ষেত্রে ভরসা। কিন্তু ঈদের সময় তিনি বাসের টিকিটের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না। দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে অন্য কোনোভাবে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন না।

আকরাম বলেন, একবার বাসের টিকিট না পেয়ে মহাখালী থেকে বিরআরটিসির ঈদ স্পেশাল দোতলা বাসে ময়মনসিংহ হয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছিলাম। তখন রাস্তার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। বিভিন্ন স্থানে ভাঙা রাস্তায় প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছিল এই বুঝি বাস উল্টে যাবে। পথে এক জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণে কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হলো। এভাবে অশেষ ভোগান্তি শেষে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। এ ছাড়া আরেকবার বাসের ব্যবস্থা না করতে পেরে ছয় হাজার টাকা দিয়ে মাইক্রোবাসে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু গাজীপুর পার হতেই আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। আবার আসার সময়ও একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করেছিলাম। কিন্তু তখনো গাজীপুর আসার আগেই যানজট শুরু হয়ে গেল। তীব্র গরমে সন্তানরা বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ল। কেন্দুয়া থেকে ঢাকা পৌঁছতে যেখানে চার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা লাগে সেখানে ১৩ ঘণ্টা লেগে গেল আমাদের বাসায় পৌঁছতে। সকাল ৮টায় রওনা হয়ে রাত ৯টায় আমরা বাসায় পৌঁছলাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো এত টাকা খরচ করেও কোনো স্বস্তি পেলাম না আমরা কেউ গাড়িতে। আর এটা হয়েছিল শুধু অসহনীয় যানজটের কারণে। এর পর থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঈদের সময় আর বাড়ি যাবো না।
আকরাম জানান এখন ঈদ ছাড়াও ঢাকা থেকে বের হতে গাজীপুর পর্যন্ত যেমন যানজট থাকে, তেমনি ঢাকায় ফেরার পথে গাজীপুর থেকে বাসা পর্যন্ত অসহনীয় যানজট লেগে থাকে। ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা লেগে যায় স্বাভাবিক সময়েও। তাহলে ঈদের সময় অবস্থা কী দাঁড়াবে ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়।

রাজধানীর বাংলামটরের বাসিন্দা জহির জানান, তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলায়। তিনি কয়েক বছর ধরে ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন না পরিবার নিয়ে। এর একমাত্র কারণ যাতায়াত ভোগান্তি আর হয়রানি। সে কারণে পরিবার রেখে ঈদের দিন সকালে তিনি বাড়ি যান বৃদ্ধ মা-বাবার সাথে দেখা করতে।
জহির জানান, বর্তমানে বিভিন্ন রুটে দিনের পর দিন যানজটে যাত্রীদের আটকে থাকার খবর দেখছি পত্রিকায়। তাতে এবার আগের মতো ঈদের দিনও বাড়ি যেতে পারব কি না সংশয় রয়েছে।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আসাদ জানান, তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। কিশোরগঞ্জ ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রাস্তাও ভালো। কিন্তু তার পরও তিনি পরিবার নিয়ে ঈদের সময় এবার বাড়ি যাবেন না। কারণ তার স্ত্রী কোমর ব্যথার রুগী। যদি যানজটের সমস্যা না থাকত তাহলে পরিবার নিয়ে বাড়ি যেতে পারতেন। কিন্তু এখন সাহস করতে পারছেন না। কারণ যানজটের কারণে কখন বাড়ি পৌঁছতে পারবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/323948