৯ জুন ২০১৮, শনিবার, ৮:১৫

কৌশলে করের পাহাড় চাপানো হয়েছে জনগণের কাঁধে

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বিশাল আকারের প্রস্তাবিত বাজেটে কৌশলে করের বোঝা চাপানো হয়েছে জনগণের কাঁধে। বরাবরের মতো কর আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিশাল তার্গেট দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় সংশোধন করা হয়েছে। আগামী বাজেটে এনবিআরের তার্গেট দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরের সংশোধীত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে এসব অর্থ আদায় করা হবে। ফলে কৌশলে করের বোঝা চাপানো হয়েছে জনগণের কাঁধে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ধনীদের সব দিক দিয়ে সুযোগ দেয়া হয়েছে কিন্তু গরিবদের জন্য কোন সুখবর নেই। বিত্তবানদের সুবিধা দিয়ে মধ্যবিত্তদের ওপর জুলুম করা হয়েছে। এটা অর্থনীতির সাম্যনীতিতে পড়ে না।
দাম বাড়ছে : ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আরোপিত কর বিদ্যমান ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। আর অতালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আরোপিত কর বিদ্যমান ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য কোম্পানি কর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আবার আনুতোষিক ব্যয় ৭৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। আর এটাও পাবেন উচ্চবিত্তরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিত্তবানদের সুবিধা দিতে সরকার এ পথ বেছে নিয়েছে। এর আগেও ব্যাংক মালিকদের নানা সুবিধা দিয়েছে সরকার। সে সময় ব্যাংক মালিকদের কাছে সরকারের নতিস্বীকার বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এ বাজেটেও একই পথে হাঁটলো সরকার।
এ ব্যাপারে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংকের লুটপাট ঠিক না করে ব্যাংক খাতের করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমানো উচিত হয়নি। এতে মালিকপক্ষ এককভাবে লাভবান হবে। ঋণগ্রহীতা এবং আমানতকারী কোনও সুবিধা পাবে না। তিনি বলেন, করমুক্ত টাকা বাড়ানো হয়নি। কিন্তু যেটা বাড়ানো হয়েছে, সেটা হলো আনুতোষিক ব্যয়, যেটা ৭৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। এটা উচ্চবিত্ত মানুষেরা পাবেন। এটা আমার কাছে বৈপরিত্য মনে হয়েছে। কেন না যখন আপনি মধ্যবিত্তের জন্য কোনো সুযোগ দিচ্ছেন না, সেখানে আপনি উচ্চবিত্তের জন্য আনুতোষিক ব্যয় সুবিধা দেবেন। এটা অর্থনীতির সাম্যনীতিতে পড়ে না।

প্রস্তাবিত বাজেটে এনার্জি ড্রিংকের উপর সম্পূরক শুল্ক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সব ধরনের প্রসাধন সামগ্রীর উপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেয়া হয়। মধু, কোকোনাট, কাজু বাদাম, কাটবাদাম, আখরোটের উপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা এবং কফি, গ্রিন টিয়ের উপর শূন্য থেকে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের প্রস্তাব দেয়া হয়। ফিনিশড চকলেট, সুপার কনফেকশনারির সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ করার প্রস্তাব একইসাথে আতর ও আগরবাতি ছাড়া সব ধরনের সুগন্ধিতে সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। সিরামিক, বাথটাব ও জ্যাকোজি, শাওয়ার ট্রের উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব এবং পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের উপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে মোবাইল ফোন আমদানিতে দুই শতাংশ সারচার্জ আরোপের প্রস্তাব অন্যদিকে ইউপিএস, আইপিএস, মোবাইল ও অন্যান্য ব্যাটারি চার্জারের শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব ও হেলিকপ্টার সেবায় ২০ শতাংশ শুল্ক হারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

পাঠাও-উবারের মতো অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সার্ভিসকে করের আওতায় আনতে প্রস্তাবিত বাজেটে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাইড শেয়ারিং সেবায় মোটরযান সেবা প্রদানকারীদের রিটার্ন দাখিল এবং ১২ ডিজিটের এনআইএন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে এবার থেকে নতুন করের আওতায় আসল রাইড শেয়ারিং সেবা। বর্তমানে দেশে রাইড শেয়ারিংয়ে উবার, পাঠাও ছাড়াও স্যাম, আমার রাইড, মুভ, বাহন, চলো অ্যাপ, ট্যাপিওয়ালা, ওই খালি, লেটস গোসহ নানা নামে বিভিন্ন কোম্পানি পরিবহন সেবা দিচ্ছে।
নতুন বাজেটে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তৈরি পোশাকের সাধারণ কারখানার করহার ১৫ শতাংশ ও তৈরি পোশাকের তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে গত বছর একক আয়কার হার ছিল ১২ শতাংশ। অন্যদিকে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবেশসম্মত ভবন সনদ (গ্রিন বিল্ডিং সার্টিফিকেশন) আছে এমন সবুজ কারখানার আয়কর হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

নতুন বাজেট প্রস্তাবে ভ্যাটের স্তর বর্তমান নয়টি থেকে পাঁচটিতে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। ফলে হার দাঁড়িয়েছে সর্বনিম্ন দুই শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। ভ্যাট বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এ প্রস্তাব কার্যকর হলে সেবার কিছু খাতে চাপ বাড়বে। কিছু খাতে কমবে। বর্তমানে ২১টি সেবাখাত আছে। এসব খাত থেকে নয়টি স্তরে ভ্যাট আদায় করা হয়। এই কর কাঠামোতে (বা সংকুচিত মূল্য ভিত্তিতে) ভ্যাট আদায় করার ফলে জটিলতা তৈরি হয় এবং হয়রানির শিকার হন ব্যবসায়ীরা। ফাঁকিও হয় প্রচুর।
আবার এই সহজীকরণের ফলে ফ্ল্যাটের খরচ বেড়ে যাবে। আগে ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ক্রেতার কাছ থেকে নিবন্ধন ফি আদায় করা হতো দেড় শতাংশ। এখন করা হবে দুই শতাংশ। খরচ বাড়বে নির্মাণ খাতের। আগে নির্মাণসংস্থায় ভ্যাট আরোপ ছিল ছয় শতাংশ। ঘোষিত বাজেট প্রস্তাবে তা সাত শতাংশ করা হয়েছে। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে এ খাতের খরচও বাড়বে।

আগামী অর্থবছরে এই দুই ধরনের ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে বড় ফ্ল্যাট (১৬০১ থেকে বেশি) নিবন্ধনের ভ্যাট হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকছে। এদিকে যারা পুরনো ফ্ল্যাট কিনবেন তাদেরও খরচ বাড়তে পারে। কারণ নতুন অর্থবছরে পুরনো ফ্ল্যাট পুনঃনিবন্ধনে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে।
ফ্ল্যাট কেনার পর ঘর সাজানোর আসবাবপত্র কিনতে গেলে আগামী অর্থবছর বাড়তি চাপে পড়তে হতে পারে ক্রেতাদের। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে আসবাবপত্র উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ১ শতাংশ করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে আসবাবপত্র উৎপাদন পর্যায়ে ৬ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। আগামী অর্থবছর থেকে তা ৭ শতাংশ হারে প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। আর বিপণন পর্যায়ে ৪ শতাংশ ভ্যাট পরিবর্তন করে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিও ফ্ল্যাট বা আবাসন ব্যবসায় কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে হাইব্রিড মোটরগাড়ি আমদানি সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ কমানো হলেও পুরাতন বা রিকন্ডিশন গাড়ির অবচয় সুবিধা বছরভিত্তিক ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে হাইব্রিড মোটর গাড়ির দাম কমবে এবং রিকন্ডিশন গাড়ির দাম কিছুটা বাড়বে।
বাজেটে বাইসাইকেলের কিছু যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক (কাস্টমস ডিউটি) বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বাইসাইকেলের দাম কিছুটা বাড়বে।
বাজেটে বাইসাইকেলের (মটরে চালিত নয়) ব্রেকের ওপর ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি ধরার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বর্তমানে রয়েছে ১০ শতাংশ। একইভাবে মটরে চালিত নয় বাইসাইকেলের সিটের (সেডল) ওপর কাস্টমস ডিউটি ১০ শতাংশ থেকে বাড়ি ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/333563